Friday, 25 December 2020

লাইফ @ তেলেনাপোতা

আমরা যখন ইলেভেন পড়ি, তার ঠিক দুবছর আগে আমাদের বোর্ডের সিলেবাস পরিবর্তন হয়। আমরা ছিলাম নতুন সিলেবাসে উচ্চমাধ্যমিক দেওয়া তৃতীয় ব্যাচ, আমাদের আগে আরও দুটো ছিল। আসলে তখন জমানা পাল্টে ছিল, তাই পুরানো নীতি আদর্শ থেকে সবকিছুর শুদ্ধিকরণ করে নতুনের জন্য তৈরি করে নিতে হবে বইকি। তাই সব্বার আগে শিক্ষায় সংস্কার জরুরি। 

আমি ছিলাম সায়েন্সের ছাত্র, তা বিজ্ঞানের নিয়ম তোহ আর চাইলেই বদলানো যায় না, তাই পরিবর্তনের আঁচ আমাদের বেলায় ওই বাংলা আর ইংরেজিতে এসেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা বাংলা মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা, ইংরেজিতে শিখি ল্যাংগুয়েজ মানে ভাষা, আর বাংলায় শিখি সাহিত্য। আমার আবার বরাবর গল্প কবিতা পড়তে বেশ লাগে, তাই বাংলা বই খানা বেশ পছন্দ হয়েছিল। সরকার বাহাদুরের অনুপ্রাণিত পন্ডিতেরা বই খানা সাজিয়ে ছিল খাসা, তবে একটাই ব্যাপার বাংলা বইখানা পড়লে মনে হত, যে সেটা পুরানো জমানার থেকেও আরও বেশি করে পুরনো আদর্শের পন্থী। গল্প কবিতা চয়নে তার ছাপ স্পষ্ট।

তা সে যাই হোক, আমার নীতি আদর্শ নিয়ে কি কাজ, ওসব ধুয়ে নেতারা জল খেয়ে থাকেন, আমার তোহ গল্প হলেই চলবে। তোহ হয়েছে কি, এরমই এক গল্প ছিল 'তেলেনাপোতা আবিস্কার।' এ গল্পের মতো বদখত গল্প আর পড়িনি মশাই, নামটাই কি অদ্ভুত। আমরা, বন্ধুরা প্রথম প্রথম বিস্তর হাসাহাসি করেছি এ নিয়ে। লেখকের নাম প্রেমেন্দ্র মিত্র দেখে ভেবেছিলাম হয়ত 'তেল দেবেন ঘনাদা'-র স্পিন অফ বা সিক্যুয়েল গোছের কিছু হবে। পড়তে গিয়ে দেখি, ধুর ঘনাদা তোহ নয়ই, উপরন্তু গল্পের ভাষাও কেমন ধারা। লেখক ক্রমাগত পাঠক কে বলছেন - এই ধরুন আপনি এখানে গেলেন, এটা করলেন, ওটা করলেন। আরে বাবা সবই যদি আমি করি তাহলে লেখক কিংবা গল্পের চরিত্র কি করবে। 

 

আসলে এ ছিল আমার জীবনে পড়া প্রথম গল্প যা কি না মধ্যম পুরুষে লেখা। বাংলার স্যার যখন গল্পটা বুঝিয়ে দেন তখন থেকে গোটা ধারণাটাই পাল্টে যায়। আসলে সবার জীবনেই কোথাও না কোথাও একটা তেলেনাপোতা আছে, কেউ সেখানে যেতে পারে আর বাকিদের কাছে তা স্বপ্নই থেকে যায়। 

 

আমাদের চারপাশে ঘটে চলে কত কি ঘটনা, আর শুধু চারপাশই বা কেন, ইতিহাসেও তোহ কত ঘটনার ঘনঘটা। এর মধ্যে কিছু ঘটনা আমাদের ভাল লাগে, কিছু রোমাঞ্চ দেয়, আবার কিছু ঘটনা মনটাকে ভাবিয়ে দেয়, দুঃখ দেয়। তবে সময় সময় মনে হয়, আচ্ছা এমন যদি হত, আমার সাথে এর মধ্যে একটা কিছু ঘটত, তাহলে বেশ হত না! কিন্তু ওই, সকলই মায়া, তুমি দেখবে তোমার পাশে ঘটছে, তোমার কান ছুঁয়ে হয়ত বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তোমার সাথে ঘটছে না। এজন্যই বলে, কপালের নাম গোপাল।

জানিনা না কার সাথে এমন হয়, আমার সাথে বারবার এরকম হয়, 'এই যাঃ ফস্কে গেল'। কিন্তু কি আর করা যাবে। 

তবুও মনের কোণে একটা আশা থাকে একদিন হবে, কিছু একটা হবে। যাতে মনে হবে, হ্যাঁ কিছু একখানা করেছি। একখানা আত্মতৃপ্তির নেশায় মনখানা ভরে যাবে, তারপর যতই দুঃখ হোক, একটা কিছু দিয়ে ভোলানো যাবে। মনে হবে না জীবনখানা বৃথা গেল। 

না, কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, অন্তত পক্ষে নিজের কাছে নিজেকে খুশি করলেই চলবে। এরম কি মনে হয় না?

অনেক সময় স্বপ্ন দেখতে দেখতে এমন হয়, যে বাস্তব আর স্বপ্ন মিলেমিশে যায়। ফারাক করা মুশকিল। একা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়, কি একা একা বিছানায় শুয়ে থাকার সময়, সে স্বপ্ন আমাদের কাছে আসে, এসে গল্প করে, সুখদুঃখের কথা বলে। সে জিনিসের সাথে এমন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, এতবার তাকে দেখি, তাই স্বপ্ন বলে তাকে আর মনেই হয় না। মনে হয় এই তোহ সেদিন কথা হল। কেউ না থাক, আমার মনের কথা আমার স্বপ্ন শুনবে। 

কেউই জানিনা, সে স্বপ্ন সফল হবে কি না, তবে ভাবতে দোষ কি! ভাবার ওপর তোহ কেউ ট্যাক্স বসায়নি, আর সমনও জারি করেনি। হয়ত যারা খুব বাস্তববাদী, তারা এসব ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেবে, বলবে অলীক কল্পনা। তাতে কি, সে তোহ আমার কল্পনা। কার কি এসে গেল তাতে। মাঝে মাঝে ভাবনার সাগরে ডুব দিয়ে দেখো, মন্দ লাগবে না। চিন্তা নেই, ডুবে তুমি যাবে না, কারণ এই বাস্তব পৃথিবী তোমায় ডুবতে দিচ্ছে না, সে ঠিক ঘাড় ধরে টেনে আনবে। কিন্তু তবুও যতক্ষণ ডুবে থাকা যায়, মন্দ কি। তখন মনে হবে, এই বেশ ভাল আছি। 

ওই বলে না পুজোর থেকে পুজো আসছে আসছেটা বেশি ভাল, তেমনই হয়ত স্বপ্ন পূরণের থেকে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচাটা মনে হয় বেশি আনন্দের। তাই আমার কাছে আমার তেলেনাপোতার জীবন খানা বেশ লাগে। মাঝে মধ্যে ঘুরে আসি। তোমরাও যাও, দেখবে বড্ড ভাল লাগবে।