Thursday 19 July 2018

পেঁয়াজ কাটলে চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন?

সেদিন ছিল রবিবার, তাতাইদের বাড়ীতে মাংস রান্না হচ্ছে। তাতাইএর ওপর ভার পড়েছিল পেঁয়াজ কাটার। তো পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে তাতাই পুরো নাজেহাল। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে সে কি অবস্থা। হঠাৎ তাতাইএর মাথায় প্রশ্ন এলো আচ্ছা পেঁয়াজ কাটলে চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন। অন্য কোন সবজি বা ফল কাটলে এইরকম হয় না কেন। পেঁয়াজে কি এমন আছে যার ঝাঁজে কান্না পেয়ে যায়। তা দাদাকে প্রশ্ন করতে দাদা বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আজ দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে তোকে পেঁয়াজ কাটলে চোখে জল আসে কেন সেটা বলব।’ 

তো সেই কথা মতো দুপুর বেলা তাতাইকে দাদা পেঁয়াজের কাহিনি বলতে আরম্ভ করল। তবে তার আগে তাতাইকে দাদা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা বলত পেঁয়াজের বিজ্ঞানসম্মত নাম কি?’
তাতাই এটা জানত, সে স্কুলের বইতে পড়েছে, চটপট উত্তর দিল, ‘অলিয়াম সেপা ( Allium cepa )।’
দাদা বলল, ‘তবে শোন, পেঁয়াজের কোশগুলোর মধ্যে অ্যালিনেজ (Allinase) উৎসেচক ও আইসোঅ্যালিন (Isoallin) নামক সালফক্সাইড গোত্রের এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এবার পেঁয়াজ কাটার সময় পেঁয়াজের কোশ গুলোও ছুরির কোপে কেটে যায়, তখন ওই উৎসেচক ও রাসায়নিক পদার্থ বাতাসের সংস্পর্শে বিক্রিয়া করে 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (1-propenyl sulfenic acid) তৈরী করে।
এরপর কোশের মধ্যে থাকা ল্যাক্রিমেটরি ফ্যাক্টর সিন্থেজ (Lachrymatory Factor Synthase) ওই 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড থেকে সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড (syn-propanthial-S-oxaide) তৈরী করে। যার সংকেত C3H6OS
এবার এই  সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড প্রচন্ড উদ্বায়ী, তৈরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসে পরিণত হয়। এবার এই গ্যাস চোখে পৌঁছলে চোখ জ্বালা শুরু করে। সেই জ্বালার ফলে চোখের মধ্যে থাকা স্নায়ু উদ্দীপিত হয় আর মস্তিকে সংবেদনা প্রেরণ করে। তখন মস্তিস্ক সেই জ্বালা কমাতে চোখের মধ্যে থাকা ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিকে জল বের করতে নির্দেশ দেয়। তখনই চোখে জল আসে।’

পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বিক্রিয়া


তাতাই বলল, ‘ আচ্ছা বুঝলাম, তবে রান্না করা পিঁয়াজে এই ঝাঁজ থাকে না কেন।’
দাদা জবাব দিল, ‘রান্না করলে ওই উৎসেচকটি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে আর সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড (syn-propanthial-S-oxaide) তৈরী হয় না। ফলে রান্না করলে সেই ঝাঁজ থাকে না। আবার একি ভাবে পেঁয়াজ কুচি কুচি করবার আগে যদি দু টুকরো করে জলে ভিজিয়ে রাখা যায়, তখন ঐ উৎসেচক অনেকটা জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। তখন পেঁয়াজ কোচালে আর ঝাঁজ লাগে না।’
তাতাই বলল, ‘আচ্ছা দাদা তবে রসুনে কান ঝাঁজ হয় না? ওটাও তো অনেকটা পেঁয়াজের মতো।’
দাদা বলল, ‘এটা বেশ ভাল প্রশ্ন করেছিস। আসলে রসুনের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম বিক্রিয়া ঘটে, কিন্তু রসুনে আইসোঅ্যালিনের পরিবর্তে থাকে অ্যালিন (Allin)।  এবার অ্যালিন উৎসেচক অ্যালিনেজের সাথে বিক্রিয়া করে 2-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (2-propenyl sulfenic acid)  তৈরী করে। যেখানে পেঁয়াজে তৈরী হয়েছিল 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (1-propenyl sulfenic acid)। এবার এই 2-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিক্রিয়া করে অ্যালিসিন (Allicin) নামক এক থায়সালফোনেট যৌগে রূপান্তরিত হয়। এই অ্যালিসিন কোন জ্বালা সৃষ্টি করে না। তাই রসুন কাটলে কোন ঝাঁজ বের হয় না।’

রসুনের ক্ষেত্রে বিক্রিয়া
  

তাতাই বলল, ‘আচ্ছা আজকাল তো অনেক হাইব্রিড ফল ও সবজি বেরোচ্ছে, তা এমন কোন পেঁয়াজ বানানো সম্ভব নয় যেটায় ঝাঁজ বের হয় না।’
দাদা বলল, ‘ হ্যাঁ, সেরকম কিছু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের একদল বিজ্ঞানী একবার এই রকমই এক হাইব্রিড পেঁয়াজ বানিয়েছিলেন, যা কাটলে চোখে জল পড়ে না। অবশ্য তা বাজারে আসেনি। আসলে গবেষণাগারে অনেক কিছুই তৈরী করা হয়, কিন্তু তার সমস্তই বাণিজ্যিক ভাবে তৈরী করা সম্ভব হয়না। দেখা যায় তাতে যা খরচ পড়বে, তা দিয়ে ব্যাবসা করে লাভ হবে না।
তবে কি জানিস, এই যে চোখের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি, এটা আমাদের চোখকে ভিজিয়ে রাখতে সাহায্য করে। আজকাল স্মার্টফোন আর কম্পিউটারের সামনে অতিরিক্ত চোখ রাখার ফলে অনেকের চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে আর তার ফলে চোখের নানা রকম অসুখ দেখা দিচ্ছে। তাছাড়াও এই ল্যাক্রিমাল গ্রন্থির ক্ষরণের ফলে চোখের মধ্যে পড়া জীবাণু গুলো বিনষ্ট হয় বা ধুয়ে যায়। যা চোখের সংক্রমণ রোধ করে, চোখ ভাল থাকে। তাই বিজ্ঞানীরা বলছে, পেঁয়াজ কাটার ফলে যে চোখ দিয়ে জল ঝরে এটা ভাল। কোন ক্ষতি নেই এতে।’



সবুজপাতা পত্রিকার ১৪২৫ সনের গ্রীষ্ম ও শরৎ যুগ্ম সংখ্যায় প্রকাশিত



সেলফি কথা

আজকাল সেলফি তোলার খুব হিড়িক। অনুষ্ঠান থেকে বন্ধুদের সাথে আউটিং, সেলফি না তুললে আপনি ঠিক আধুনিক হতে পারলেন কই। শুধু তুললেই হবে না, ঘটা করে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করতে হবে।
অক্সফোর্ড ডিকশনারির ২০১৩ সালে ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার হওয়া সেলফি শব্দের সংজ্ঞা হল  “a photograph that one has taken of oneself, typically one taken with a smartphone or webcam and uploaded to a social media website.
বোঝ কান্ড, তার মানে এমনি সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে নিজেই নিজের ছবি তুললে সেটা গ্রাহ্য হবে না। তাহলে সেটাকে কি বলব? উত্তর হল, সেটাকে বলব photographic self-portrait। সে যা যা বলুক গে, আমরা আপাতত নিজেই ছবি নিজের ছবি তোলাকে সেলফি বলে ধরে নিই তাহলে বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে না। তো মাঝে মধ্যেই মনে প্রশ্ন জাগে যে প্রথম সেলফি কে তুলেছিল। 
কর্নেলিয়াসের তোলা প্রথম সেলফি 


অধিকাংশের মতে প্রথম সেলফি তুলেছিলেন রবার্ট কর্নেলিয়াস। উত্তর আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার এক অ্যামেচার রসায়নবিদ ছিলেন এই কর্নেলিয়াস। তো ১৯৩৯ সালের একদিন তিনি, তার বাড়ির দোকানের পিছনে ক্যামেরা বসিয়েছেন। কিন্তু ছবি তোলার জন্য কাউকে পাচ্ছেন না। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজেই লেন্স ক্যাপ খুলে ক্যামেরার সামনে এক মিনিট বসে থাকলেন, তারপর লেন্স ক্যাপটা লাগিয়ে দিলেন। ডেভেলপ করার পর দেখলেন তার ছবি এসেছে। ছবির পিছনে আবার লিখলেন “The first light Picture ever taken. 1839.”
কর্নেলিয়াসে তোলা দ্বিতীয় সেলফি 







এই ছবি তোলার পরেও কর্নেলিয়াস আরেকটি ছবি তুলেছিলেন নিজের। সেটা প্রথম ছবি তোলার চার বছর পর। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে কর্নেলিয়াস তার রসায়নগারে একটি বোতল ও একটি বিকার থেকে কিছু তরল ফানেলের মাধ্যমে অন্য একটি  বিকারে ঢালছে। এই ছবিটায় কর্নেলিয়াসের মুখ খুন একটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না অবশ্য।





এরপর একটু বাংলায় ফিরে আসি। বাংলায় প্রথম সেলফি কে তুলেছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। স্পষ্ট করে কেউ কিছু জানে না। তবে সত্যজিৎ রায় তার যুবক বয়সে ক্যামেরার শাটারের সাথে সুতো বেঁধে তার মায়ের সাথে একটি ছবি তুলেছিলেন। অনেকে এটাকে বাংলায় প্রথম photographic self-portrait বলে দাবি করেন। 

সত্যজিৎ রায়ের তোলা photographic self-portrait
এরপর আসি মহাকাশে। মহাকাশে প্রথম সেলফি তোলেন বাজ অলড্রিন। ১৯৬৬ সালে জেমিনি ১২ অভিযানে তিনি মহাকাশে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা হাঁটার পর এই সেলফি তোলেন।

মহাকাশে প্রথম সেলফি 
এতক্ষন তো গেল মানুষে সেলফি তোলার কথা, শুনেছেন বাঁদরে সেলফি তুলেছিল। আজ্ঞে হ্যাঁ সত্যি। শুধু তাই নয় সেই সেলফির স্বত্বাধিকার নিয়ে মামলা পর্যন্ত হল।
তো হয়েছিল কি, ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের ফটোগ্রাফার ডেভিড স্লটার ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছিলেন বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলতে। সেখানে তিনি ছবি তুলতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে ভুলেই যান তাঁর আরও একটি ক্যামেরার কথা। ডেভিডের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে নারুতো নামে এক ম্যাকাক বাঁদর ক্যামেরাটি নিয়ে খেলতে শুরু করে। একগাদা ছবিও তোলে বাঁদরটি। তার বেশির ভাগ ঝাপসা হলেও নিজের ঝাঁ চকচকে সেলফি তুলতে ভুল করেনি বাঁদরটি। এরপর বহু কায়দা করে ডেভিড তার ক্যামেরাটি হাতে পান। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল সব কিছু।
এরপরে ‘ওয়াইল্ডলাইফ পার্সোনালিটিজ ‘নামক এক গ্রন্থে বাঁদরের সেলফিটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উইকিপিডিয়ার প্রকাশক উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন তাদের ওয়েবসাইটে এই অভিনব সেলফি প্রকাশ করে এবং ছবিটি নিয়ে হইচই পড়ে যায়। এখনও পর্যন্ত মানুষ ব্যাতীত অন্যকোনও প্রাণীর সেলফি এই প্রথম। ফলে স্বভাবতই এই নিয়ে উৎসাহ চরমে পৌঁছায়। কিন্তু উইকিমিডিয়ার উপর বেজায় চটেগেলেন ডেভিড। তার দাবি এই ছবির কপিরাইট তার। উইকিমিডিয়ার ওয়েবসাইট থেকে পৃথিবীর একমাত্র বাঁদরের সেলফি সরিয়ে নেওয়ার দাবি তুলেলন তিনি। মামলা গড়াল কপিরাইট আদালত অবধি। ডেভিডের যুক্তি, ‘ফটোগ্রাফি খুবই খরচসাপেক্ষ একটি শিল্প। ২০১১-তে ইন্দোনেশিয়া গিয়ে ছবি তুলতে গিয়ে আমার দু’হাজার ডলারের বেশি খরচ হয়েছিল। এ ছবির মালিক আমি। কারণ, ক্যামেরা আমার। বাঁদর শুধু ক্লিক করেছিল। ওই ছবিটির জন্য তিন বছরে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন ডলার লাভ করতাম। সে সুযোগ বঞ্চিত হয়েছি’। অপরদিকে উইকিপিডিয়া ডেভিডের যুক্তি মানতে নারাজ। উইকিপিডিয়া কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, সেলফি তুলেছে বাঁদরটি নিজে। তাই এই ছবির কপিরাইটে ডেভিডের কোনো অধিকার নেই।
শেষ পর্যন্ত উইকিপিডিয়া কর্তৃপক্ষের জয় হয়। কপিরাইট আইনে কোনও ছবির মালিকানা তাঁর উপর বর্তায় যিনি ক্যামেরার শাটার ক্লিক করেছেন। এক্ষেত্রে কিন্তু কাজটি করেছে ম্যাকাক বাঁদরটি স্বয়ং। অতএব সে যতদিন না এসে কপিরাইট দাবি করছে ততদিন সম্ভবত নিশ্চিন্তে থাকতে পারে উইকিপিডিয়া।

বাঁদরের তোলা সেই সেলফি 


এরপর আরেকটি মামলা করে পশুপ্রেমিক সংগঠন পেটা। তাদের দাবি, ওই সেলফি-র কপিরাইট ম্যাকাক বাঁদরটির।
যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ফটোগ্রাফার শুধু ক্যামেরাটি রেখেছিলেন। কিন্তু সেলফি তোলার কৃতিত্ব ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ সুলাওয়েসির ৬ বছরের ম্যাকাক মাঙ্কি নারুতোর। তাই ওই ছবি থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় অর্থ নারুতো ও ওই সংরক্ষিত অরণ্যে বসবাসকারী তার প্রজাতির অন্যান্যদের জন্য ব্যয় করার আর্জি জানিয়েছে পেটা। এই মামলার রায়েও ডেভিড হেরে যান, আদালত রায় দেয় ওই সেলফিটি থেকে বা সেটিকে বিক্রি করে যা আয় তিনি করেছেন তার ২৫ শতাংশ ওই প্রজাতির বাঁদরের সংরক্ষণে ব্যয় করতে হবে।
বেচারা ডেভিড, কে জানত একটা ছবির জন্য এতো ঝামেলা হবে তার।

Thursday 12 July 2018

হারিয়ে যাওয়া বিজ্ঞানী - এত্তেরিও মাইয়োরানা

২৫শে মার্চ ১৯৩৮, ইতালির পালেরমো থেকে নেপলস যাওয়ার পথে জাহাজ থেকে একজন বিজ্ঞানী হারিয়ে যান। জাহাজে তাকে উঠতে দেখা গেলেও নামতে কেউ দেখেনি। অনেক খোঁজ করেও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি তার। অথচ তিনি থাকলে নোবেল প্রাইজ ছিল তার হাতের মুঠোয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাকে অনেক খুঁজেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। কিন্তু কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি তার। কোথায় গেলেন তিনি ?
 
*********



ইউরোপ তখন উত্তাল, বিশ্ব জোড়া আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে সমস্ত দেশ। বেকারত্ব হুহু করে বাড়ছে। সেই সুযোগে দেশে দেশে মাথাচাড়া দিচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ।
এই সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা প্রযুক্তির উন্নতির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছেন। তারা চাইছিলেন উন্নত প্রযুক্তি। যা যুদ্ধে ও দেশে শিল্পের উন্নতিতে সহায়ক। তাই পদার্থবিদ্যা ও প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষণা এই সময় এক উচ্চতায় পৌঁছয়। 

এই সময়, ১৯৩২ সালে আইরিন জোলিও কুরি ও ফ্রেদরিক কুরি গামা রে নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাদের মনে হচ্ছিল পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসে প্রোটন ছাড়াও আরেকটি অজানা কোন কণা আছে। কিন্তু তাদের আগেই এই কণার ধারণা দিয়েছিলেন এনরিকো ফার্মির ছাত্র, অনামী এক বিজ্ঞানী। ফার্মি তাকে বলেছিলেন সেই নিয়ে একটি গবেষণা পত্র লিখতে কিন্তু তিনি তা গুরুত্ব দেননি। পরবর্তীকালে সেই অনামী কণা (নিউট্রন) আবিষ্কারের জন্য নোবেল পান জেমস চ্যাডউইক। কিন্তু তখন কে জানত পরের কয়েক দশকে এই অনামী বিজ্ঞানীই হয়ে উঠবেন আলোড়ন ফেলে দেওয়া সবচেয়ে রহস্যময় ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। কে তিনি ?


**********

তিনি এত্তেরিও মাইয়োরানা। তার সম্পর্কে এনরিকো ফার্মি বলেছিলেন - "পৃথিবীতে অনেক ধরণের বিজ্ঞানী আছেন। কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর, যারা তাদের সেরাটা দিয়ে থাকে, কিন্তু তাতেও বেশি দূর যেতে পারে না। তারপর আসে প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী, যাদের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। কিন্তু তারও পরে থাকেন জিনিয়াসরা, যেমন নিউটন ও গ্যালেলিও। তাদের মধ্যেই একজন হলেন মাইয়োরানা।"

এত্তরিও মাইয়োরানা



অসম্ভব প্রতিভাবান ছিলেন এই ইতালিয় পদার্থবিদ, গণিতেও অসাধারণ দক্ষতা। ১৯০৬ সালের ৫ই অগস্ট, সিসিলির ক্যাটনিয়ায় জন্ম। তার কাকা কুইরিনো মাইয়োরানা পদার্থবিদ ছিলেন। সেই কাকার থেকেই তার পদার্থবিদ্যা ও গণিতে আগ্রহ জাগে তার। ১৯২৩ সালে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়া শুরু করলেও ১৯২৮ সালে এমিলিও সেগ্রের অনুরোধে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি এনরিকো ফার্মির অ্যাটমিক স্পেক্ট্রোস্কপি তত্ত্বকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করে গবেষণা পত্র লিখেছিলেন। সেই গবেষণা পত্র পড়ার পর একসাথে গবেষণা করার জন্য তাকে ডেকে নিয়েছিলেন এনরিকো ফার্মি।

এরপর ফার্মির পরামর্শে ১৯৩৩ সালে তিনি জার্মানির লিপজিগ যান, সেখানে ন্যাশানাল রিসার্চ কাউন্সিলের থেকে অনুদান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সেখানেই তার সাথে আলাপ হয় হাইসেনবার্গের সাথে। সেখানে মেজেরানা নিউক্লিয়াসের উপর গবেষণা শুরু করেন। এরপর তিনি কোপেনহেগেন যান, সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় নীলস বোরের। 

সেই সময়ই নাৎসি পার্টি জার্মানির ক্ষমতায় আসে। অনেক খ্যাতনামা গবেষক ইহুদি হওয়ার জন্য তাদের জার্মানি ছাড়তে হয়। অরাজকতার সবে আরম্ভ হয়েছে। এদিকে মাইয়োরানা স্নায়বিক দুর্বলতা ও গ্যাস্ট্রাইটিসের সমস্যায় ভুগছেন। সব কিছু মিলিয়ে তার জার্মানিতে বসবাস দুঃসহ হয়ে উঠছিল। বাধ্য হয়ে জার্মানি ছাড়েন তিনি এবং রোমে ফিরে আসেন।
খাওয়া-দাওয়ার অনিয়মের জন্য তার শরীর আরও ভেঙ্গে পড়তে লাগল। তার বিজ্ঞান গবেষণার কাজও অনেকটা থমকে গেছিল। প্রায় টানা চার বছর সন্ন্যাসীর মতো নিজেকে সমস্ত কিছু থেকে সরিয়ে রাখেন। সামান্য কয়েকটি গবেষণা পত্র লিখেছিলেন এই সময়ে। অধিকাংশই ছিল অপ্র
কাশিত। 
এরপর ১৯৩৭ সালে তিনি আবার গবেষণা শুরু করেন। ইউনিভার্সিটি অফ নেপলসে ত্বাত্তিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এই সময় তিনি তার শেষ গবেষণাপত্রটি লেখেন। ইলেকট্রন ও তার অ্যান্টি পার্টিকেল পজিট্রনের ওপর। এই ম্যাটার আর অ্যান্টি ম্যাটারের ওপর কাজটিই তার শেষ প্রকাশিত কাজ ছিল।কিন্তু তারপরই দুম করে হারিয়ে গেলেন তিনি। আর সেই যে গেলেন তো গেলেন, কেউ তার খোঁজ পেল না।



**********

দিনটা ছিল ২৫শে মার্চ ১৯৩৮ সাল, পালেরমো থেকে নেপলস যাচ্ছিলেন তিনি। ওই দিনই তাকে শেষ দেখা গেছিল। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যে তিনি পালেরমোতে কি করতে গেছিলেন?

কেউ বলেন তিনি এমিলিও সেগ্রের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। কিন্তু এমিলিও সেগ্রে তখন ক্যালিফোর্নিয়াতে ছিলেন। তার পক্ষে ইতালি আসা অসম্ভব ছিল। কারণ সেই সময় মুসোলিনি এমন একটি আইন তৈরী করেন যার ফলে প্রবাসী ইহুদিরা দেশে ফিরতে পারতেন না। ইহুদি এমিলিও সেগ্রের তাই তখন ইতালিতে থাকার কথায় নয়।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে পালেরমো যাওয়ার আগে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সমস্ত টাকা তুলে নেওয়া হয়। তবে কি তিনি পরিকল্পিত ভাবে অন্তর্হিত হয়েছিলেন ?
আবার ওই ২৫ শে মার্চেই তিনি নেপলস ফিজিক্স ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা আন্তেনিয় কারেলি একটা চিঠি পাঠান। চিঠির বক্তব্য অদ্ভুত ও অস্পষ্ট। তাতে মাইয়োরানা বলেছিলেন -

প্রিয় কারেলি

                  আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি যেটা কোন মতেই এড়ানো যাচ্ছিল না। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বার্থপরতা নেই আমার, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি আমার এই হঠাৎ অন্তর্ধানের সিদ্ধান্তের ফলে তোমার এবং ছাত্রদের অনেক অসুবিধা হবে। গত কয়েক মাসে তুমি আমায় সহানুভূতি ও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলে, আমাকে বিশ্বাস করে ছিল, তার সমস্ত কিছুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য আমার ক্ষমা করো। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, আমার কথা সবাইকে মনে করানোর জন্য, যাদের আমি জানতে পেরেছি তোমার ইন্সটিটিউটে এসে। আমিও তাদের সবাইকে মনে রাখব আজ রাত ১১টা পর্যন্ত, আর সম্ভব হলে তার পরেও। 

                                                                                                               ইতি            এত্তেরিও মাইয়োরানা


 এই চিঠি দেখেই কেউ কেউ মনে করেন মাইয়োরানা বোধহয় আত্মহত্যা করেছেন। কারণ রাত ১১টার উল্লেখ দেখে মনে হতেই পারে ওই দিন রাত ১১টার পর আর তিনি বেঁচে থাকেন নি।
কিন্তু অনেকেই আবার মনে করেন তিনি আত্মহত্যা করার মতো মানুষ ছিলেন না। আর যদি আত্মহত্যাই করেন তবে ব্যাঙ্ক থেকে সমস্ত টাকা তুলে নেবেন কেন? আসলে তিনি নিজে থেকেই অন্তর্হিত হয়েছিলেন।
এত্তেরিও মাইয়োরানার নিখোঁজ সংবাদ, ইতালিয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত



এত্তেরিও মাইয়োরানাকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? এই নিয়ে খবর বেরিয়েছিল ১৯৩৮ সালে ১৭ জুলাই লা ডোমিনিকা দেল কোরিয়ে নামক ইতালিয় সংবাদপত্রে
তার এই অন্তর্ধান সম্পর্কে ফার্মি বলেন, "এত্তেরিও খুব বুদ্ধিমান। সে যদি নিজেই গা ঢাকা দিয়ে থাকে তবে তাকে খুঁজে বের করতে কেউ পারবে না।"
কেউ কেউ মনে করেন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে বন্দি করে। সেই সময় বেনিটো মুসোলিনি নিজে এই রহস্য সমাধানে উদগ্রীব হন। এমনকি মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেন। পুরস্কার মূল্য ধার্য্য হয় ৩০ হাজার লিরা। কারণ অবশ্য তখন একটাই। সব দেশ তখন পরমাণু অস্ত্রের খোঁজ চালাচ্ছে। আর অনেকেই মনে করেন মাইয়োরানার যা বুদ্ধিমত্তা, তা দিয়ে তিনি পরমাণু বোমা বানাতে পারেন।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পরেও এফবিআই তাকে পাগলের মতো খুঁজেছে। এই সন্দেহে যে, কোন দেশ বা সংস্থা তাকে দিয়ে পরমাণু বোমা বানাচ্ছে কি না। । কিন্তু সব কিছুই ধোঁয়াশা।

এরপর ১৯৭৫ সালে ইতালিয় লেখক লিওনার্দো শাশা, মাইয়োরানার অন্তর্ধান সম্পর্কে একটি বই লেখেন। সেখানে তিনি দাবি করেন এত্তেরিও মাইয়োরানা আর্জেন্টিনা চলে যান। সেখানে গিয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বাকি জীবন কাটান। কিন্তু এমিলিও সেগ্রে এই মত খারিজ করে দেন। তাদের মতে এত্তেরিও মাইয়োরানা আত্মহত্যা করেছিলান।

 



*********

এত্তেরিও মাইয়োরানার অন্তর্ধানের ৭০ বছর পর  ২০০৮ সালে একটি অবাক করা ঘটনা ঘটে। ইতালিয় টেলিভিশনে 'কি লা'হ ভিস্তো' (কে একে দেখেছে) নামক একটি অনুষ্ঠান হত। সেখানে একটি পর্বে এত্তেরিও মাইয়োরানার সম্পর্কে বলা হচ্ছিল। হঠাৎ একটি ফোন আসে। ফ্রান্সেস্কো ফাসানি নামক এক ব্যাক্তি দাবি করে বসেন তিনি মাইয়োরানাকে দেখেছেন। ফাসানি বলেন, তিনি ১৯৫৫ সালে ভেনেজুয়েলা যান। সেখানে তিনি তার সিসিলিয়ান বন্ধু সিরোর সাথে ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাস থেকে ভ্যালেন্সিয়া যান। সেখানে কার্লো নামক এক আর্জেন্টিনিয় ভদ্রলোকের মাধ্যমে মিঃ বিনি নামে এক ব্যাক্তির সাথে আলাপ হয়। বিনি ছিল  শুভ্রকেশযুক্ত এক ভদ্রলোক, অনেকটা রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগছিল। সে ছিল অন্তর্মুখী ও উদাসী মানুষ। তার কথায় রোমান টান ছিল। আরও যে ব্যাপারটা ফাসানিকে আগ্রহী করেছিল, সেটা হল বিনি হাতঘড়ি পরেছিল জামার হাতার ওপরে, সচারাচর ঘড়ি হাতার নীচে থাকে। কিন্তু সম্ভ্রান্ত রোমান পরিবারে হাতার ওপর ঘড়ি পরা ছিল একটি রীতি। উল্লেখযোগ্য হল মাইয়োরানার ঠাকুরদাদা এক সময় ছিলেন ইতালির কৃষি মন্ত্রী এবং মাইয়োরানারা বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল।
ফ্রান্সেস্কো ফাসানি ভেনেজুয়েলাতে গাড়ির মেকানিক হিসেবে কাজ করতো। বিনির একটি হলুদ রঙের স্টুডবেকার গাড়ি ছিল। কিন্তু ফাসানির মতে বিনি এতটাই গরিব ছিল, যে তার মনে হয়ে ছিল বিনির কাছে শুধু গাড়িতে গ্যাসোলিন ভরার টাকাই আছে। গাড়ি সারাবার খরচের মতো টাকা নেই। তো ফাসানি সেই গাড়ির মধ্যে কিছু কাগজপত্র দেখতে পান। সেই কাগজ পত্রের মধ্যে ১৯২০ সালে কুইরিনো মাইয়োরানার লেখা একটা পোস্টকার্ড ছিল, যেটা না কি W.G. নামক কোন এক আমেরিকানকে লেখা। এছাড়া ফাসানি একটি নোটবই পান, যেটা নাকি বিভিন্ন অঙ্ক ও ফর্মুলায় ভর্তি ছিল।
এরপর কার্লো তাকে বলেন, এই বিনি আসলে হলেন বিজ্ঞানী মাইয়োরানা। কার্লোর সাথে বিনির নাকি আর্জেন্টিনায় দেখা হয়েছিল। তখন ফাসানি বিনির সাথে একটি ছবি তুলতে চান। কিন্তু বিনি নারাজ। এরপর একদিন বিনি ১৫০ বলিভার ধার চায় ফাসানির কাছে, তখন ফাসানি তার বদলে বিনির সাথে ছবি তুলতে চায়। পরবর্তীকালে ফাসানি ছবিটিকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু টিভিতে মাইয়োরানাকে নিয়ে দেখাতে তার মনে পড়ে সবকিছু ও সে ফোন করে জানায় টেলিভিশন অফিসে। এই ঘটনার পরে ইতালিতে শোরগোল পড়ে যায়।  মাইয়োরানার কেসটি নতুন করে খোলা হয়। আবার অনুসন্ধান শুরু হয়।
বাম দিকে ফ্রান্সেস্কো ফাসানির সাথে ডান দিকের ব্যাক্তিটি ইত্তেরিও মাইয়োরানা বলে দাবি করা হয়

অনেকেই এই ছবিটি দেখে এনাকে মাইয়োরানা বলেন, কারণ ডান পাশের ব্যাক্তিটির সাথে এত্তেরিও মাইয়োরানার বাবার বৃদ্ধ বয়সের ছবির সাথে সম্পূর্ণ মিলে গেছিল। সব মিলিয়ে যা দাঁড়িয়ে ছিল তা হল, এই যে, মাইয়োরানা ১৯৫৫ সালের কিছু আগে আর্জেন্টিনা থেকে ভেনেজুয়েলা যান। কিন্তু কেন আর্জেন্টিনা গেছিলেন, সেখান থেকে কেনই বা ভেনেজুয়েলা গেছিলেন তা জানা গেল না।


*********

এইসব ঘটনার দু বছর পর  ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ বলোনে-র অধ্যাপক জর্জো দ্রাগোনি নতুন কিছু তথ্য তুলে ধরেন।  তিনি এত্তেরিও মাইয়োরানার অন্তর্ধানের ওপরে অনুসন্ধান করছিলেন। তিনি সাইমন উইজেন্থালের একটি বই, 'জাস্টিস, নট রিভেঞ্জ' (১৯৯৯) এর থেকে ছবি দেখান।
জর্জো দ্রাগোনি
ছবিটি ১৯৫০ সালে তোলা হয়েছিল। ছবিটির ক্যাপশান ছিল 'নাজি হান্টার অ্যান্ড দা হলোকাস্ট সারভাইভার।' যেখানে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বুয়েনস আইরিস গামী একটি জাহাজে। সেখানে মাঝের ভদ্রলোকটিকে নাৎসি সেনানায়ক অ্যাডলফ ইচম্যান বলেছিলেন সাইমন উইজেন্থাল। কিন্তু পাশের দুজনের পরিচয় ছিল না। এখন দ্রাগোনি একপাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে এত্তেরিও বলে দাবি করছেন।
মাঝখানে মাথায় টুপি পরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি অ্যাডলফ ইচম্যান, আর ছবির বামদিকে কালো চশমা পরে যিনি তাকেই এত্তেরিও মাইয়োরানা বলে দাবি করা হয়


সেই ছবির সাথে এত্তেরিওর ছবির সম্পূর্ণ মিল পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি তথ্য স্পষ্ট হয় যে এত্তেরিও মেজেরানা আর্জেন্টিনা চলে গেছিলেন।
এই একই ছবি থেকে ইত্তেরিও মাইয়োরানার  কথা ২০১০ সালের ১৭ অক্টোবর 'লা রিপাবলিকা' নামক ইতালিয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সেখানেও ছবির বামদিকের ব্যাক্তিকে মাইয়োরানা বলা হয়। 'লা রিপাবলিকা' সংবাদপত্রের সাংবাদিক জোসেফ বরেলো ও আরও দুই তরুণ সাংবাদিকের সাথে একটি বই লিখেছেন, লা সেকন্দা ভিতা দি মাইয়োরানা (মাইয়োরানার দ্বিতীয় জীবন)।
 


*********


ইত্তেরিও কিভাবে হারিয়ে গেলেন, কোথায় গেলেন এই রহস্যের আজও সমাধান হয়নি। আরেক ইতালিয় সাংবাদিক অ্যাঞ্জেলো প্যারাটিকা দাবি করেন তিনি আর্জেন্টিনাতেই থেকে যান, সেখানে পাদ্রীর কাজ করতেন। তিনি ভেনেজুয়েলা যাননি। আবার কেউ কেউ দাবি করেন ৮০-র দশকে তাকে রোমের রাস্তায় দেখা গেছে। কিন্তু তিনি কোথায় তা সম্পর্কে নিশ্চিত কেউ কিচ্ছু বলতে পারেনি।

লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের অধ্যাপক জোয়াও ম্যাগুইজো এই নিয়ে অনেক অনুসন্ধান করেন। তিনি ইত্তেরিওর বাড়ি গিয়েও তদন্ত করেন, সেখান থেকে তিনি কিছু অপ্রকাশিত গবেষণা পত্র পান। যযার মধ্যে ছিল কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স এর ওপর গবেষণা। যে কাজের জন্য ১৯৬৫ সালে নোবেল পান রিচার্ড ফাইনম্যান।
যদি সত্যি সত্যি তিনি তার সমস্ত গবেষণা প্রকাশ করতেন তবে তিনি একাধিক নোবেল পেতে। জেমস চ্যাডউইক থেকে রিচার্ড ফাইনম্যান- এদের সবার আগেই গবেষণায় এগিয়ে ছিলেন এত্তেরিও মাইয়োরানা। এনরিকো ফার্মি কোন ভুল বললেননি , এত্তেরিও মাইয়োরানা ছিলেন সত্যিকারের এক জিনিয়াস।
                                                               

Tuesday 3 July 2018

পাঠ পরবর্তী ভাব - তারাভরা আকাশের নীচে - শ্রীজাত



কোন কবি যখন গদ্য লেখেন, তখন তা স্বাদু গদ্য হয়ে ওঠে। আর চার-পাঁচ জন গদ্য লেখকের থেকে ভিন্ন। তেমনই এক উপন্যাস 'তারাভরা আকাশের নীচে'। গল্প শুরু হচ্ছে ১৮৮৮ সালের এক শীতসন্ধে থেকে, যখন আর্লে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের সাথে দেখা করতে আসছেন পল গগ্যাঁ। তিনি যখন কড়া নেড়ে ঢুকে পড়লেন ভিনসেন্টের বাড়িতে, তার পাশাপাশি পাঠকও ঢুকে পড়লেন ভিনসেন্টের আশ্চর্য দুনিয়ায়। যে ভিনসেন্ট চলে এসেছে প্যারিস ছেড়ে, কারণ ঘিঞ্জি প্যারিস তার ভাল লাগছিল না। কোথাও একটা তার মধ্যে নগর সভ্যতা থেকে পালানোর মনোবৃত্তি কাজ করছে।   আর তার সাথে প্রবল এক উন্মাদনা কাজ করছে ভিনসেন্টের মধ্যে। যার জন্য হঠাৎ করে অপমান করে বসেন পল গগ্যাঁকে। সেই উন্মাদনা থেকে কেটে ফেলেন নিজের কান। তারপর সেই রক্ত মাখা কান কাগজে মুড়িয়ে তুলে দেন গণিকার হাতে। এদিকে তাঁর সমস্ত পাগলামি সহ্য করে , তাকে মন প্রাণ দিয়ে সাহায্য করছে তাঁর ভাই থিও ভ্যান গঘ। ভিনসেন্টের জীবনে সে হল পরিবার ও ভিনসেন্টের মাঝে একমাত্র যোগসূত্র।
পাশাপাশি সামন্তরাল ভাবে গল্প এগোতে থাকে ২০১৭ সালে এক বিজ্ঞাপন জগতের কর্মী ঋত্বিকের জীবন ঘিরে। সে আঁকিয়ে হতে চেয়েছিল কিন্তু বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা আর বাড়ির চাপে সে সিধান্ত বদল করে। এছাড়া ঋত্বিক আর তাঁর ভাইয়ের সম্পর্ক ও ভাইয়ের অতীত স্মৃতি এসব তাড়া করে বেরায় তাকে। সব মিলেয়ে মধ্য তিরিশের ঋত্বিক হ্যালুসিনেশনে ভুগতে থেকে। মাঝে মধ্যেই কল্পনার জগতে চলে যায়। তার সব থেকে প্রিয় ছবি 'দ্য স্টারী নাইট'। এসব সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হতে থাকে তাঁর স্ত্রী শর্মিলা। তাকে নিয়ে যায় সাইক্রিয়াটিস্ট রুখসার আহমেদের কাছে। কিন্তু ঋত্বিকের সমস্যা মেটে না।
   

আসলে গল্প বলা এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য নয়। একজন শিল্পীর মধ্যে যে শৈল্পিক উন্মাদনা কাজ করে , যে উন্মাদনা তাঁর কল্পনাকে চাগিয়ে রাখে, সেই উন্মাদনার সাথে বাস্তবটা মেলে না। বা বলা ভাল আর চার-পাঁচ জন যেটাকে বাস্তব বলে দাগিয়ে দিতে চায় সেই বাস্তবের সাথে। যে দ্বন্দে দীর্ণ ভিনসেন্ট ও ঋত্বিক, দুজনেই। আসলে আমরা সাদা চোখে যেটাকে দেখি সেটাকে বাস্তব বলে মেনে নিই। আর যখন অন্য কেউ অন্য কোন ভাবে জগৎকে দেখে সেটাকে আমরা কল্পনা বলে দিই। আসলে বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শুধু আলাদা ভাবে দেখা। কিন্তু জগতের নিয়মে, বলা ভাল গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের নিয়মে যখন সেই আলাদা দেখা তাকে আমরা উন্মাদনা বলে দেগে দিই, তখন সেই ভিন্ন ভাবে ভাবুক মানুষগুলো আমাদের ঠিক করে দেওয়া বাস্তব আর কল্পনার মাঝখানে আটকা পড়ে যায়।
এই মানুষগুলো রাজা সিসিফাসের মতো, যার তেজ সবাই সহ্য করতে না পেরে তাকে সারা জীবন পাথর বইতে দিয়েছিল। যাতে তাঁর তেজ কমে যায়। আমরাও সেরকম এই মানুষগুলোকে শাস্তি দিয়ে ফেলি। আর এরাও তা থেকে পরিত্রাণ পায় না। সিসিফাসের মতো এরাও সারা জীবন এক অস্বস্তির পাথর বয়ে নিয়ে চলে তাঁর গোটা জীবন ধরে। কোন এক সময় সেই ভার অসহ্য হলে এরা থেমে যায়, আর তাতেই এদের মুক্তি। তাতেই এদের প্রকৃত বেঁচে থাকা।
এই উপন্যাসে দুটি মানুষের দুটি সামন্তরাল গল্প যেন বহতা নদীর মতো। তির তির করে বয়ে চলেছে, এক অদ্ভুত সুন্দর ফ্লো আছে এই উপন্যাসে। একদম শেষে গিয়ে দুই নদী সুন্দর ভাবে মিলে যায়। আর  পাঠক, যে কবির হাত ধরে সওয়ার হয়েছিল নদী ভ্রমণের নৌকায়, সেই নৌকা ছেড়ে যাওয়ার পর দুলুনি রয়ে যায় তার মনের শরীরে। সেই দুলুনি নিয়েই শেষ করতে হয় উপন্যাসটি। উপন্যাসের শেষে পাঠক পড়ে থাকেন, এক মোহনায় , যেখানে বাস্তব ও কল্পনার নদী এসে মিলেছে। যেখানে তাদের মধ্যে কোন ভেদ নেই, আছে শুধু মিল। যে গন্তব্যে যেতে চায় ভিনসেন্ট ও ঋত্বিক।


পুনশ্চঃ সম্প্রতি স্বপ্নসন্ধানী তারাভরা আকাশের নীচে উপন্যাস থেকে তারায় তারায় নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে চলেছে। নাটকের নির্দেশনায় কৌশিক সেন। চমকের ব্যাপার ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চরিত্রে অঞ্জন দত্ত। এছাড়া ঋত্বিকের চরিত্রে ঋদ্ধি সেন, শর্মিলার চরিত্রে সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রুখসার আহমেদের চরিত্রে রেশমি সেন। নাটকের আবহ ও সঙ্গীত পরিচালনায় নীল দত্ত। আশা করছি একটি দুর্দান্ত নাটক দেখতে পাওয়া যাবে। সেই আশায় রইল বাংলার নাট্যপ্রেমী মানুষ। 

আমার রবীন্দ্রনাথ - দ্বিতীয় পর্ব

আমাদের প্রাইমারী স্কুলের পাঠ্য বইয়ে রবীন্দ্রনাথের গল্পসল্প থেকে একটা গল্প ছিল - দাঁড় ও পাল। মূল গল্প 'বড় খবর'-এর প্রথমাংশটা।   তখন সেই সময় গল্পটা আমার বেশ মজার লেগেছিল। মানে ছোটবেলায় আমার ভাল লাগা রবীন্দ্রনাথের একমাত্র গল্প বলা যায়। তখন অবশ্য গল্পটার আভ্যন্তরিন অর্থ বুঝিনি। বাবা বলেছিলেন গল্পটা নাকি দারুণ। আমি অতশত বুঝিনি ভাল লেগেছিল ব্যাস। আমার দাঁড় ও পালের মধ্যে ঝগড়াটা বেশ মজার লেগেছিল।

রবীন্দ্রনাথের গল্প প্রথম উপলব্ধি করি হাই স্কুলে উঠে। আমাদের প্রধান পাঠ্য বইয়ের সাথে একটা করে সহায়ক পাঠ বই থাকত। তো সেই সহায়ক পাঠেই 'ছুটি' গল্পটা ছিল। আর গল্পে ফটিকের বয়স আমাদের তখনকার বয়সের মতোই। এই বয়স শৈশব ও যৌবনের মাঝামাঝি পর্যায়। ওই সময়ের অবস্থাকে এত সুন্দর করে যেন কেউ আর বলেনি। পড়লেই মনে হত আরে এতো আমারও কথা।

"তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই । শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না । স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে । তাহার মুখে আধো-আধো কথা ও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্ৰগলভতা ......... তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায় ; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মৰ্মে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবাৰ্য ক্রটিও যেন অসহ বোধ হয় ............  এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিম্বা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না ; কারণ সেটি সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে । "

মনে হয়েছিল, সত্যি তো এভাবে কেউ আমার জন্য কোনদিন বলেনি তো। কোথাও একটা মনের ভিতরে রবীন্দ্রনাথ জায়গা করে নিলেন, মনে হল এ বড় আপনার জন, এ আমার রবীন্দ্রনাথ।  আর কারও নয়। যে কথা কাউকে বলা যায়না, তিনিই যেন বলে দিয়েছেন সে কথা। আমাকে মুখ ফুটে অনুযোগ করতে হয়নি। সবচেয়ে মনে ধরেছিল এই কথাটা -  "এই বয়সে সাধারণত নারীজাতিকে কোনো-এক শ্রেষ্ঠ স্বৰ্গলোকের দুর্লভ জীব বলিয়া মনে ধারণা হইতে আরম্ভ হয়, অতএব তাহাদের নিকট হইতে উপেক্ষা অত্যস্ত দুঃসহ বোধ হয়।"   মোক্ষম লেগেছিল এই জায়গাটা।

পরে ভেবে দেখেছি কিশোর সাহিত্য অনেকে লিখেছেন। হয়তো আরও লিখবেন, কিন্তু এভাবে একটি কিশোরের মনোভাব তুলে ধরতে। অন্যরা কিশোরদের জন্য লেখা বলতে হয়  রহস্য রোমাঞ্চ বুঝেছেন না হলে 'হও ধরমেতে বীর'-মার্কা গল্প।  কিন্তু কিশোররা কি চায় তা বুঝতে চাননি। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, তাই তো তিনি রবীন্দ্রনাথ। হয়তো আজ - রবীন্দ্রনাথকে কেন ভাল লাগে - জিজ্ঞেস করলে বলব অন্য কোন কারন, কিন্তু সেই সময় জিজ্ঞেস করলে বলতাম 'ছুটি'।
সেই সময়ের পর থেকে রবীন্দ্রনাথের সাথে এক অভেদ্য সম্পর্কে যেন জড়িয়ে পড়ি। তারপর থেকে যেখানে আর কোন ভাঙ্গন ধরেনি।





 আমার রবীন্দ্রনাথ - প্রথম পর্বের লিঙ্ক

Sunday 1 July 2018

আমার রবীন্দ্রনাথ - প্রথম পর্ব


                       ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির 
                      পাঁচ বোন থাকে কালনায়,
                     শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়,
                       হাঁড়িগুলো রাখে আলনায়।

ছোটবেলায় 'ছড়ার মজা' বলে আমাকে একটা বই কিনে দেওয়া হয়েছিল। উপরের কবিতার লাইনগুলি বইটার প্রথম কবিতার প্রথম চার লাইন। ছোট্ট বইটা ছিল এমনই সব মজার কবিতায় ভরা। বই এর লেখক শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর এভাবেই আমার সাথে প্রথম আলাপ সেই গল্পদাদুর। হ্যাঁ দাদুই বটে, ছবিটা প্রথম দেখে শুধু আমার কেন যে কোন বাচ্চাই সেটা মনে করবে। যেন কোন রূপকথা দেশের লোক। ইয়া লম্বা দাড়ি, আর পা থেকে মাথা অবধি জোব্বা পড়ে আছেন। সব কিছুর মধ্যে যেন মুখটা ছোট্ট করে দেখা যাচ্ছে, বলা ভাল উঁকি দিচ্ছে যেন। তখন আমার বয়স তিন কি চার, তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি।
এরপর আর সমস্ত বাঙালি শিশুর মতোই আমিও স্কুলে গেলুম, আর হাতে পেলুম সহজ পাঠ।
                   ছোট খোকা বলে অ আ 
                শেখেনি সে কওয়া।


ধীরে ধীরে পাঠ এগোতে থাকল। ক্লাস ২এর পর আমরা আর সহজ পাঠ পরিনি, কিন্তু সেই স্মৃতি গুলো মনে থেকে গেছে। এবার একটা মজার কথা বলি। সহজ পাঠের প্রথম দিককার কবিতা গুলো বেশ ছন্দ মিলিয়ে পড়া যেত। পড়তে ভালোই লাগত। কিন্তু শেষের দিকে "ষ্টীমার আসিছে ঘাটে, প’ড়ে আসে বেলা" বলে একটা কবিতা ছিল। কিন্তু তখন সেই সব ছন্দ বুঝতাম না। শুধু জানতাম লাইনের শেষে এসে থামতে হয়। আর এতেই হতো বিপত্তি। কবিতাটা পড়লে এই রকম শোনাত। “শূন্য হয়ে গেল তীর আকাশের কোণে / পঞ্চমীর চাঁদ ওঠে দূরে বাঁশবনে / শেয়াল উঠিল ডেকে মুদির দোকানে।” অবাক হয়ে যেতাম। কি রকম বোকা বোকা লাগত আমার। আর এদিকে দাড়ি কমা অনুযায়ী থামলে তাতে মানে হত, কিন্তু ছন্দ পেতাম না ঠিক। ভাবতাম কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। এখন এই কথা গুলো মনে পড়লে বেশ হাসি পায়।
         

পৃথিবীতে হয়তো অনেক প্রাইমার আছে। বাংলা ভাষাতেও আছে আরো। কিন্তু সহজ পাঠ কোথাও একটা আলাদা। মনের অনেক ভিতরে।
এরপর ক্লাস এগিয়েছে, একটু একটু করে বড় হয়েছি। প্রতি ক্লাসেই অন্তত একটা করে রবীন্দ্রনাথের পদ্য ও গদ্য থাকত। তবে শুধু পাঠ্য বইয়েও নয়, তার বাইরেও রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা পড়েছিলাম। তখন আমাকে বাড়ি থেকে আরও দুটো কবিতার বই কিনে দেওয়া হয়েছিল - 'শিশু' আর 'শিশু ভোলানাথ'। তবে সব কবিতা গুলো যে পড়তাম তা নয়। যেগুলো ভাল লাগত, সেই গুলোই বারে বারে পড়তাম। তারমধ্যে শিশু বইটা থেকে 'মাস্টারবাবু' কবিতাটা বেশ প্রিয় ছিল। কবিতাটা এতবার পড়েছিলাম মুখস্ত হয়ে গেছিল।
তবে এছাড়াও কিছু কবিতা মুখস্ত করতে হয়েছিল। স্কুলে পরীক্ষার জন্য আর পাড়ায় রবীন্দ্র জয়ন্তীর জন্য। তখন রবীন্দ্র জয়ন্তী ছিল আমার কাছে বেশ একটা উত্তেজক ব্যাপার-স্যাপার। তবে একটা জিনিস কবিতা বলব, মঞ্চে উঠব এটা নিয়ে বেশ আনন্দ থাকেলেও আসল মজাটা টের পেতাম মুখের সামনে মাইকটা পাওয়ার পর। বার বার মনে হত এই যদি ভুলে যাই। তবে আমার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল, মানে এখনও আছে আর কি। আমি কবিতা বলাকালীন কবিতা থেকে কিছু শব্দ মুছে দিয়ে নিজের মতো কিছু শব্দ বসিয়ে নিতাম। এতে একটা জিনিস হত, মঞ্চে বলার সময় ঘাবড়ে যেতাম না। কিন্তু সমস্যাটা হত এর পরে। ভীষণ বকা খেতাম আরকি। কারণ রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা গুলো কম বেশি সবার জানা। ফলে ফাঁকি দেওয়ার কোন উপায় ছিল না।
শিশু ভোলানাথ বইটা থেকে একটা কবিতা আমার বেশ ভাল লাগত - খেলা ভোলা। কবিতাটা অবশ্য সহজ পাঠেও ছিল। কবিতার লাইন গুলো পড়লেই কি রকম চোখের সামনে ছবি ভেসে উঠে।
 শীতের বেলায় দুই পহরে
দূরে কাদের ছাদের ’পরে
ছোট্ট মেয়ে রোদদুরে দেয়
 বেগনি রঙের শাড়ি।
Related image
শিশু ভোলানাথের আরেকটা কবিতাটার সাথে নিজের মনের কথাটা খুব মিলে যেত। সেটা হল রবিবার কবিতা। সত্যি আমিও ওই রবিবারের জন্য সারা হপ্তা অপেক্ষা করেতাম, আর আমারও এটাই মনে হত 
  সোম মঙ্গল বুধ এরা সব
          আসে তাড়াতাড়ি,
এদের ঘরে আছে বুঝি
          মস্ত হাওয়া - গাড়ি?
রবিবার সে কেন, মা গো,
           এমন দেরি করে?

এই ভাবে আমার একদম ছোটবেলা জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে শুধু কবিতাও নয়, আমার গানও ভাল লাগত। অবশ্য এ ভাল লাগা মানে সুর বা ছন্দটা ভাল লাগা, কথা বোঝার মতো বয়স হয়নি। এর মধ্যে একটা গান ছিল, আমরা সবাই রাজা। এই গানটাতে আমি ছোটবেলায় একটা দলবদ্ধ নৃত্যনাট্যে নেচেছিলাম। সেই সুরটা বড় ভাল লেগেছিল। আর একটা গানের ছন্দটা বেশ ভাল লাগে, গানটা কেউ না থাকলে মনের আনন্দে একা একা গাইতাম। অবশ্য সুর মিলত না। সেটা হল-
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥
হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ--
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥

তবে একটা জিনিস এই সময়টায় সেভাবে রবীন্দ্রনাথের গদ্যের দিকে আকর্ষিত হয়নি। কেন জানি না ওই সহজ পাঠের পর রবীন্দ্রনাথের গদ্য আর ছোটবেলায় সেভাবে পড়া হয়নি। ওই দশ-বারো বছর নাগাদ কে একটা গল্প গুচ্ছ উপহার দিয়েছিল। কে দিয়েছিল মনে নেই, তবে জন্মদিনের উপহার এটা মনে আছে। সেখান থেকে তখন কটা গল্প পড়েছিলাম। প্রথম গল্প পড়েছিলাম ক্ষুদিত পাষাণ। এক দাদা বলেছিল ভাল গল্প, কিন্তু পড়ে আমার ভাল লাগেনি তখন, আসলে ওই বয়সে ওটা পড়া ঠিক হয়নি, কিন্তু তখন অতশত বুঝতাম না। আর এটা পড়ার পর আমার একটা ধারণা হয় যে রবীন্দ্রনাথ কবিতাই ভাল লেখেন, আর উনি তো বিশ্বকবি, কবিতাই লেখা উচিত। খামোকা কেন যে গেলেন গল্প লিখতে, কে জানে বাবা।  তবে এ ধারণাও ভেঙ্গেছিল আর দু-এক বছর পরই। সে গল্প বলব পরের পর্বে। আজ এটুকুই থাক।


আমার রবীন্দ্রনাথ - দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক