Sunday 29 March 2020

আমার রবীন্দ্রনাথ - তৃতীয় পর্ব

তখন ক্লাস টেন, ততদিনে বেশ অনেকগুলোয় কবিতা, গল্প পড়া হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের। তার কিছুটা পাঠ্যবইয়ের দৌলতে আর কিছু নিজের চেষ্টায়। পালাবদলের দৌলতে রবীন্দ্রসঙ্গীত তখন রাস্তার মোড়ে আর পাড়ায় পাড়ায় বাজতে শুরু করেছে। তবে কি না ওই গল্প ও কবিতার মত  তার অর্থগুলো খুব একটা স্পষ্ট হয়নি। সুর ভাল লাগত, তাই শুনতাম, মানে বুঝতাম না খুব একটা।
তবে কি না তখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পড়ে দেখা হয়নি। সেই সময়তে একদিন ঋতুপর্ণ ঘোষের 'চোখের বালি' দেখি টিভিতে, পুরোটা নয়, ওই কিছু কিছু অংশ। মনে হয় বাড়িতে কেউ দেখছিল, সেখান থেকে ফুলুক-ফালুক কয়েক ঝলক দেখা।
সেই থেকে মাথায় ঢুকল 'চোখের বালি' পড়তে হবে। তার একটা কারণও ছিল, ততদিনে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাস সবই পড়া হয়ে গেছে। ফলত রোম্যান্টিক উপন্যাসের স্বাদ পেয়ে গেছি, তো বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকের রোম্যান্টিক উপন্যাস কিরকম হয়, তা তো চেখে দেখা হয়নি। সেই তাগিদ থেকেই আরও উৎসাহ বাড়ল। তো যেমন ভাবা তেমন কাজ, তুলে নিয়ে এলাম লাইব্রেরী থেকে 'চোখের বালি'। দ্বিগুণ উৎসাহে পড়া আরম্ভ হল, কিন্তু কিছুদের যেতেই রণে ভঙ্গ দিলাম। কি কারণ জানি না, ভাষা হোক কি গল্প বলার কায়দা কোনটাই পছন্দ হল না ঠিকঠাক। আর পছন্দ না হলে জোর করে অতো বড় উপন্যাস পড়ার মানে হয় না। ফলত রবীন্দ্র উপন্যাস এর প্রতি একখানা বিতৃষ্ণার ভাব জন্মাল।
এর প্রায় মাসখানেক পর, আমার বন্ধু রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা পড়াল আমায়। কবিতাটা ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত একটা কবিতার বইয়ে। কবিতাটা অনেকটা এই এইরকম -

পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায়ে আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।

নাই আমাদের কনক-চাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ কখন সন্ধ্যেবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণ মেঘেরে তুচ্ছ,
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেনড্রনগুচ্ছ।

নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন,
নাই রে ঘরের লালন-ললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্কচিৎ কিরণে দীপ্ত।



কবিতাটা পড়ে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি এটা রবীন্দ্রনাথের, জিজ্ঞেস করলাম বন্ধুকে "কোন কাব্যগ্রন্থে আছে ?" 
ও বলল, " কাব্যগ্রন্থ নয়, উপন্যাস।"  
"উপন্যাস ! কি উপন্যাস ?" 
"শেষের কবিতা।" 

নামখানা মগজে ঢুকে গেল। পড়ে দেখতে হবে একবার। কবিতাটা অবাক করেছিল আরও 'রডোডেনড্রনগুচ্ছ' কথাটার জন্য। কারণ রবীন্দ্রনাথ অনেক বিদেশি ফুলের নামকরণ করেছিলেন, যেগুলো শুনতে অনেকবেশি শ্রুতি মধুর, কিন্তু রডোডেনড্রন, যা কি না কিরকম গাছ পালার ল্যাটিন নামের মতই খটমট শোনায়, সেটাকে না পালটে সরাসরি কবিতায় ব্যবহার ভারী অবাক করেছিল।
তার ওপর বন্ধু বলেছিল এই উপন্যাসটা না কি রবীন্দ্রনাথের অন্য সব উপন্যাস থেকে আলাদা। 
তবে এইবার আর সঙ্গে সঙ্গে গিয়েই উপন্যাসটা খুঁজ পড়তে বসিনি। কে জানে হয়ত আগের অভিজ্ঞতা হয়ত উৎসাহে ভাঁটা ফেলে দিয়েছিল। তো যাকগে সে কথা, সময় করে একদিন উপন্যাসটা পড়েই ফেললাম। পড়ার সময় কতকগুলো জিনিসে চোখ আটকাল, যার মধ্যে অন্যতম উপন্যাসটার ভাষা আর গল্প বলার কায়দা। পড়ে মনে হল, 'আরে! এতো এখনকার ভাষায় কথা বলছে।' ৮০-৯০ বছরে একটা ভাষায় বেশ ভালই পরিবর্তন আসে, তা পড়লেই বোঝা যায়, কিন্ত এতো তা নয়, মনে হল এ যে অসম্ভব। তরতর করে পড়তে থাকছিলাম, মাঝে মাঝে কবিতাও বেশ দারুণ। 
যখন পড়া শেষ করলাম, তখন অদ্ভুত একটা মন ভাললাগা কাজ করছিল। কি জানি কেন, মনে হতে লাগল, আরে এতো যেন আমার মনের মত উপন্যাস। 
আগেই বলেছি, শরদিন্দুর রোম্যান্টিক উপন্যাস পড়া হয়েগেছে, প্ত্র পত্রিকার দৌলতে সমকালীন লেখকদের উপন্যাস ও কিছু আন্তর্জাতিক উপন্যাসও পড়ে ফেলেছি ততদিনে। কিন্তু শেষের কবিতা পড়ে মনে হল ধুর ধুর কোথায় লাগে ওইসব রোম্যান্টিক উপন্যাস গল্প। অমিত-লাবণ্য তখন মনের গহনে ঢুকে পড়েছে।
পরে জেনে অবাক হয়েছিলাম যখন এই উপন্যাস লেখা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৬০ ছাড়িয়ে গেছে। ভাবতে অবাক লাগে মনের মধ্যে কতটা যৌবন থাকলে ওই বয়সে ওতটা প্রাণবন্ত উপন্যাস লেখা যায়, যা এক কিশোরের মনেও হিল্লোল তুলবে। 
এরপরে আমি দেশি-বিদেশি অনেক রোম্যান্টিক উপন্যাস পড়েছি, কিন্তু 'শেষের কবিতা'-র মতো একটাও উপন্যাস পায়নি। আজ পর্যন্ত আমার কাছে শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক উপন্যাস 'শেষের কবিতা'। সন্ধানে আছি এখনও আরও ভাল উপন্যাস পড়ার। খুঁজে চলেছি। যদি না পাই, তাহলে হয়ত এটাই সত্য হবে যে -  "বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।"