Thursday 19 July 2018

পেঁয়াজ কাটলে চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন?

সেদিন ছিল রবিবার, তাতাইদের বাড়ীতে মাংস রান্না হচ্ছে। তাতাইএর ওপর ভার পড়েছিল পেঁয়াজ কাটার। তো পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে তাতাই পুরো নাজেহাল। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে সে কি অবস্থা। হঠাৎ তাতাইএর মাথায় প্রশ্ন এলো আচ্ছা পেঁয়াজ কাটলে চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন। অন্য কোন সবজি বা ফল কাটলে এইরকম হয় না কেন। পেঁয়াজে কি এমন আছে যার ঝাঁজে কান্না পেয়ে যায়। তা দাদাকে প্রশ্ন করতে দাদা বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আজ দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে তোকে পেঁয়াজ কাটলে চোখে জল আসে কেন সেটা বলব।’ 

তো সেই কথা মতো দুপুর বেলা তাতাইকে দাদা পেঁয়াজের কাহিনি বলতে আরম্ভ করল। তবে তার আগে তাতাইকে দাদা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা বলত পেঁয়াজের বিজ্ঞানসম্মত নাম কি?’
তাতাই এটা জানত, সে স্কুলের বইতে পড়েছে, চটপট উত্তর দিল, ‘অলিয়াম সেপা ( Allium cepa )।’
দাদা বলল, ‘তবে শোন, পেঁয়াজের কোশগুলোর মধ্যে অ্যালিনেজ (Allinase) উৎসেচক ও আইসোঅ্যালিন (Isoallin) নামক সালফক্সাইড গোত্রের এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এবার পেঁয়াজ কাটার সময় পেঁয়াজের কোশ গুলোও ছুরির কোপে কেটে যায়, তখন ওই উৎসেচক ও রাসায়নিক পদার্থ বাতাসের সংস্পর্শে বিক্রিয়া করে 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (1-propenyl sulfenic acid) তৈরী করে।
এরপর কোশের মধ্যে থাকা ল্যাক্রিমেটরি ফ্যাক্টর সিন্থেজ (Lachrymatory Factor Synthase) ওই 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড থেকে সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড (syn-propanthial-S-oxaide) তৈরী করে। যার সংকেত C3H6OS
এবার এই  সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড প্রচন্ড উদ্বায়ী, তৈরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসে পরিণত হয়। এবার এই গ্যাস চোখে পৌঁছলে চোখ জ্বালা শুরু করে। সেই জ্বালার ফলে চোখের মধ্যে থাকা স্নায়ু উদ্দীপিত হয় আর মস্তিকে সংবেদনা প্রেরণ করে। তখন মস্তিস্ক সেই জ্বালা কমাতে চোখের মধ্যে থাকা ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিকে জল বের করতে নির্দেশ দেয়। তখনই চোখে জল আসে।’

পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বিক্রিয়া


তাতাই বলল, ‘ আচ্ছা বুঝলাম, তবে রান্না করা পিঁয়াজে এই ঝাঁজ থাকে না কেন।’
দাদা জবাব দিল, ‘রান্না করলে ওই উৎসেচকটি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে আর সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড (syn-propanthial-S-oxaide) তৈরী হয় না। ফলে রান্না করলে সেই ঝাঁজ থাকে না। আবার একি ভাবে পেঁয়াজ কুচি কুচি করবার আগে যদি দু টুকরো করে জলে ভিজিয়ে রাখা যায়, তখন ঐ উৎসেচক অনেকটা জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। তখন পেঁয়াজ কোচালে আর ঝাঁজ লাগে না।’
তাতাই বলল, ‘আচ্ছা দাদা তবে রসুনে কান ঝাঁজ হয় না? ওটাও তো অনেকটা পেঁয়াজের মতো।’
দাদা বলল, ‘এটা বেশ ভাল প্রশ্ন করেছিস। আসলে রসুনের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম বিক্রিয়া ঘটে, কিন্তু রসুনে আইসোঅ্যালিনের পরিবর্তে থাকে অ্যালিন (Allin)।  এবার অ্যালিন উৎসেচক অ্যালিনেজের সাথে বিক্রিয়া করে 2-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (2-propenyl sulfenic acid)  তৈরী করে। যেখানে পেঁয়াজে তৈরী হয়েছিল 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (1-propenyl sulfenic acid)। এবার এই 2-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিক্রিয়া করে অ্যালিসিন (Allicin) নামক এক থায়সালফোনেট যৌগে রূপান্তরিত হয়। এই অ্যালিসিন কোন জ্বালা সৃষ্টি করে না। তাই রসুন কাটলে কোন ঝাঁজ বের হয় না।’

রসুনের ক্ষেত্রে বিক্রিয়া
  

তাতাই বলল, ‘আচ্ছা আজকাল তো অনেক হাইব্রিড ফল ও সবজি বেরোচ্ছে, তা এমন কোন পেঁয়াজ বানানো সম্ভব নয় যেটায় ঝাঁজ বের হয় না।’
দাদা বলল, ‘ হ্যাঁ, সেরকম কিছু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের একদল বিজ্ঞানী একবার এই রকমই এক হাইব্রিড পেঁয়াজ বানিয়েছিলেন, যা কাটলে চোখে জল পড়ে না। অবশ্য তা বাজারে আসেনি। আসলে গবেষণাগারে অনেক কিছুই তৈরী করা হয়, কিন্তু তার সমস্তই বাণিজ্যিক ভাবে তৈরী করা সম্ভব হয়না। দেখা যায় তাতে যা খরচ পড়বে, তা দিয়ে ব্যাবসা করে লাভ হবে না।
তবে কি জানিস, এই যে চোখের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি, এটা আমাদের চোখকে ভিজিয়ে রাখতে সাহায্য করে। আজকাল স্মার্টফোন আর কম্পিউটারের সামনে অতিরিক্ত চোখ রাখার ফলে অনেকের চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে আর তার ফলে চোখের নানা রকম অসুখ দেখা দিচ্ছে। তাছাড়াও এই ল্যাক্রিমাল গ্রন্থির ক্ষরণের ফলে চোখের মধ্যে পড়া জীবাণু গুলো বিনষ্ট হয় বা ধুয়ে যায়। যা চোখের সংক্রমণ রোধ করে, চোখ ভাল থাকে। তাই বিজ্ঞানীরা বলছে, পেঁয়াজ কাটার ফলে যে চোখ দিয়ে জল ঝরে এটা ভাল। কোন ক্ষতি নেই এতে।’



সবুজপাতা পত্রিকার ১৪২৫ সনের গ্রীষ্ম ও শরৎ যুগ্ম সংখ্যায় প্রকাশিত



সেলফি কথা

আজকাল সেলফি তোলার খুব হিড়িক। অনুষ্ঠান থেকে বন্ধুদের সাথে আউটিং, সেলফি না তুললে আপনি ঠিক আধুনিক হতে পারলেন কই। শুধু তুললেই হবে না, ঘটা করে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করতে হবে।
অক্সফোর্ড ডিকশনারির ২০১৩ সালে ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার হওয়া সেলফি শব্দের সংজ্ঞা হল  “a photograph that one has taken of oneself, typically one taken with a smartphone or webcam and uploaded to a social media website.
বোঝ কান্ড, তার মানে এমনি সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে নিজেই নিজের ছবি তুললে সেটা গ্রাহ্য হবে না। তাহলে সেটাকে কি বলব? উত্তর হল, সেটাকে বলব photographic self-portrait। সে যা যা বলুক গে, আমরা আপাতত নিজেই ছবি নিজের ছবি তোলাকে সেলফি বলে ধরে নিই তাহলে বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে না। তো মাঝে মধ্যেই মনে প্রশ্ন জাগে যে প্রথম সেলফি কে তুলেছিল। 
কর্নেলিয়াসের তোলা প্রথম সেলফি 


অধিকাংশের মতে প্রথম সেলফি তুলেছিলেন রবার্ট কর্নেলিয়াস। উত্তর আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার এক অ্যামেচার রসায়নবিদ ছিলেন এই কর্নেলিয়াস। তো ১৯৩৯ সালের একদিন তিনি, তার বাড়ির দোকানের পিছনে ক্যামেরা বসিয়েছেন। কিন্তু ছবি তোলার জন্য কাউকে পাচ্ছেন না। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজেই লেন্স ক্যাপ খুলে ক্যামেরার সামনে এক মিনিট বসে থাকলেন, তারপর লেন্স ক্যাপটা লাগিয়ে দিলেন। ডেভেলপ করার পর দেখলেন তার ছবি এসেছে। ছবির পিছনে আবার লিখলেন “The first light Picture ever taken. 1839.”
কর্নেলিয়াসে তোলা দ্বিতীয় সেলফি 







এই ছবি তোলার পরেও কর্নেলিয়াস আরেকটি ছবি তুলেছিলেন নিজের। সেটা প্রথম ছবি তোলার চার বছর পর। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে কর্নেলিয়াস তার রসায়নগারে একটি বোতল ও একটি বিকার থেকে কিছু তরল ফানেলের মাধ্যমে অন্য একটি  বিকারে ঢালছে। এই ছবিটায় কর্নেলিয়াসের মুখ খুন একটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না অবশ্য।





এরপর একটু বাংলায় ফিরে আসি। বাংলায় প্রথম সেলফি কে তুলেছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। স্পষ্ট করে কেউ কিছু জানে না। তবে সত্যজিৎ রায় তার যুবক বয়সে ক্যামেরার শাটারের সাথে সুতো বেঁধে তার মায়ের সাথে একটি ছবি তুলেছিলেন। অনেকে এটাকে বাংলায় প্রথম photographic self-portrait বলে দাবি করেন। 

সত্যজিৎ রায়ের তোলা photographic self-portrait
এরপর আসি মহাকাশে। মহাকাশে প্রথম সেলফি তোলেন বাজ অলড্রিন। ১৯৬৬ সালে জেমিনি ১২ অভিযানে তিনি মহাকাশে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা হাঁটার পর এই সেলফি তোলেন।

মহাকাশে প্রথম সেলফি 
এতক্ষন তো গেল মানুষে সেলফি তোলার কথা, শুনেছেন বাঁদরে সেলফি তুলেছিল। আজ্ঞে হ্যাঁ সত্যি। শুধু তাই নয় সেই সেলফির স্বত্বাধিকার নিয়ে মামলা পর্যন্ত হল।
তো হয়েছিল কি, ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের ফটোগ্রাফার ডেভিড স্লটার ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছিলেন বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলতে। সেখানে তিনি ছবি তুলতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে ভুলেই যান তাঁর আরও একটি ক্যামেরার কথা। ডেভিডের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে নারুতো নামে এক ম্যাকাক বাঁদর ক্যামেরাটি নিয়ে খেলতে শুরু করে। একগাদা ছবিও তোলে বাঁদরটি। তার বেশির ভাগ ঝাপসা হলেও নিজের ঝাঁ চকচকে সেলফি তুলতে ভুল করেনি বাঁদরটি। এরপর বহু কায়দা করে ডেভিড তার ক্যামেরাটি হাতে পান। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল সব কিছু।
এরপরে ‘ওয়াইল্ডলাইফ পার্সোনালিটিজ ‘নামক এক গ্রন্থে বাঁদরের সেলফিটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উইকিপিডিয়ার প্রকাশক উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন তাদের ওয়েবসাইটে এই অভিনব সেলফি প্রকাশ করে এবং ছবিটি নিয়ে হইচই পড়ে যায়। এখনও পর্যন্ত মানুষ ব্যাতীত অন্যকোনও প্রাণীর সেলফি এই প্রথম। ফলে স্বভাবতই এই নিয়ে উৎসাহ চরমে পৌঁছায়। কিন্তু উইকিমিডিয়ার উপর বেজায় চটেগেলেন ডেভিড। তার দাবি এই ছবির কপিরাইট তার। উইকিমিডিয়ার ওয়েবসাইট থেকে পৃথিবীর একমাত্র বাঁদরের সেলফি সরিয়ে নেওয়ার দাবি তুলেলন তিনি। মামলা গড়াল কপিরাইট আদালত অবধি। ডেভিডের যুক্তি, ‘ফটোগ্রাফি খুবই খরচসাপেক্ষ একটি শিল্প। ২০১১-তে ইন্দোনেশিয়া গিয়ে ছবি তুলতে গিয়ে আমার দু’হাজার ডলারের বেশি খরচ হয়েছিল। এ ছবির মালিক আমি। কারণ, ক্যামেরা আমার। বাঁদর শুধু ক্লিক করেছিল। ওই ছবিটির জন্য তিন বছরে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন ডলার লাভ করতাম। সে সুযোগ বঞ্চিত হয়েছি’। অপরদিকে উইকিপিডিয়া ডেভিডের যুক্তি মানতে নারাজ। উইকিপিডিয়া কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, সেলফি তুলেছে বাঁদরটি নিজে। তাই এই ছবির কপিরাইটে ডেভিডের কোনো অধিকার নেই।
শেষ পর্যন্ত উইকিপিডিয়া কর্তৃপক্ষের জয় হয়। কপিরাইট আইনে কোনও ছবির মালিকানা তাঁর উপর বর্তায় যিনি ক্যামেরার শাটার ক্লিক করেছেন। এক্ষেত্রে কিন্তু কাজটি করেছে ম্যাকাক বাঁদরটি স্বয়ং। অতএব সে যতদিন না এসে কপিরাইট দাবি করছে ততদিন সম্ভবত নিশ্চিন্তে থাকতে পারে উইকিপিডিয়া।

বাঁদরের তোলা সেই সেলফি 


এরপর আরেকটি মামলা করে পশুপ্রেমিক সংগঠন পেটা। তাদের দাবি, ওই সেলফি-র কপিরাইট ম্যাকাক বাঁদরটির।
যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ফটোগ্রাফার শুধু ক্যামেরাটি রেখেছিলেন। কিন্তু সেলফি তোলার কৃতিত্ব ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ সুলাওয়েসির ৬ বছরের ম্যাকাক মাঙ্কি নারুতোর। তাই ওই ছবি থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় অর্থ নারুতো ও ওই সংরক্ষিত অরণ্যে বসবাসকারী তার প্রজাতির অন্যান্যদের জন্য ব্যয় করার আর্জি জানিয়েছে পেটা। এই মামলার রায়েও ডেভিড হেরে যান, আদালত রায় দেয় ওই সেলফিটি থেকে বা সেটিকে বিক্রি করে যা আয় তিনি করেছেন তার ২৫ শতাংশ ওই প্রজাতির বাঁদরের সংরক্ষণে ব্যয় করতে হবে।
বেচারা ডেভিড, কে জানত একটা ছবির জন্য এতো ঝামেলা হবে তার।

Thursday 12 July 2018

হারিয়ে যাওয়া বিজ্ঞানী - এত্তেরিও মাইয়োরানা

২৫শে মার্চ ১৯৩৮, ইতালির পালেরমো থেকে নেপলস যাওয়ার পথে জাহাজ থেকে একজন বিজ্ঞানী হারিয়ে যান। জাহাজে তাকে উঠতে দেখা গেলেও নামতে কেউ দেখেনি। অনেক খোঁজ করেও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি তার। অথচ তিনি থাকলে নোবেল প্রাইজ ছিল তার হাতের মুঠোয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাকে অনেক খুঁজেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। কিন্তু কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি তার। কোথায় গেলেন তিনি ?
 
*********



ইউরোপ তখন উত্তাল, বিশ্ব জোড়া আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে সমস্ত দেশ। বেকারত্ব হুহু করে বাড়ছে। সেই সুযোগে দেশে দেশে মাথাচাড়া দিচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ।
এই সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা প্রযুক্তির উন্নতির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছেন। তারা চাইছিলেন উন্নত প্রযুক্তি। যা যুদ্ধে ও দেশে শিল্পের উন্নতিতে সহায়ক। তাই পদার্থবিদ্যা ও প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষণা এই সময় এক উচ্চতায় পৌঁছয়। 

এই সময়, ১৯৩২ সালে আইরিন জোলিও কুরি ও ফ্রেদরিক কুরি গামা রে নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাদের মনে হচ্ছিল পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসে প্রোটন ছাড়াও আরেকটি অজানা কোন কণা আছে। কিন্তু তাদের আগেই এই কণার ধারণা দিয়েছিলেন এনরিকো ফার্মির ছাত্র, অনামী এক বিজ্ঞানী। ফার্মি তাকে বলেছিলেন সেই নিয়ে একটি গবেষণা পত্র লিখতে কিন্তু তিনি তা গুরুত্ব দেননি। পরবর্তীকালে সেই অনামী কণা (নিউট্রন) আবিষ্কারের জন্য নোবেল পান জেমস চ্যাডউইক। কিন্তু তখন কে জানত পরের কয়েক দশকে এই অনামী বিজ্ঞানীই হয়ে উঠবেন আলোড়ন ফেলে দেওয়া সবচেয়ে রহস্যময় ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। কে তিনি ?


**********

তিনি এত্তেরিও মাইয়োরানা। তার সম্পর্কে এনরিকো ফার্মি বলেছিলেন - "পৃথিবীতে অনেক ধরণের বিজ্ঞানী আছেন। কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর, যারা তাদের সেরাটা দিয়ে থাকে, কিন্তু তাতেও বেশি দূর যেতে পারে না। তারপর আসে প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী, যাদের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। কিন্তু তারও পরে থাকেন জিনিয়াসরা, যেমন নিউটন ও গ্যালেলিও। তাদের মধ্যেই একজন হলেন মাইয়োরানা।"

এত্তরিও মাইয়োরানা



অসম্ভব প্রতিভাবান ছিলেন এই ইতালিয় পদার্থবিদ, গণিতেও অসাধারণ দক্ষতা। ১৯০৬ সালের ৫ই অগস্ট, সিসিলির ক্যাটনিয়ায় জন্ম। তার কাকা কুইরিনো মাইয়োরানা পদার্থবিদ ছিলেন। সেই কাকার থেকেই তার পদার্থবিদ্যা ও গণিতে আগ্রহ জাগে তার। ১৯২৩ সালে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়া শুরু করলেও ১৯২৮ সালে এমিলিও সেগ্রের অনুরোধে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি এনরিকো ফার্মির অ্যাটমিক স্পেক্ট্রোস্কপি তত্ত্বকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করে গবেষণা পত্র লিখেছিলেন। সেই গবেষণা পত্র পড়ার পর একসাথে গবেষণা করার জন্য তাকে ডেকে নিয়েছিলেন এনরিকো ফার্মি।

এরপর ফার্মির পরামর্শে ১৯৩৩ সালে তিনি জার্মানির লিপজিগ যান, সেখানে ন্যাশানাল রিসার্চ কাউন্সিলের থেকে অনুদান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সেখানেই তার সাথে আলাপ হয় হাইসেনবার্গের সাথে। সেখানে মেজেরানা নিউক্লিয়াসের উপর গবেষণা শুরু করেন। এরপর তিনি কোপেনহেগেন যান, সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় নীলস বোরের। 

সেই সময়ই নাৎসি পার্টি জার্মানির ক্ষমতায় আসে। অনেক খ্যাতনামা গবেষক ইহুদি হওয়ার জন্য তাদের জার্মানি ছাড়তে হয়। অরাজকতার সবে আরম্ভ হয়েছে। এদিকে মাইয়োরানা স্নায়বিক দুর্বলতা ও গ্যাস্ট্রাইটিসের সমস্যায় ভুগছেন। সব কিছু মিলিয়ে তার জার্মানিতে বসবাস দুঃসহ হয়ে উঠছিল। বাধ্য হয়ে জার্মানি ছাড়েন তিনি এবং রোমে ফিরে আসেন।
খাওয়া-দাওয়ার অনিয়মের জন্য তার শরীর আরও ভেঙ্গে পড়তে লাগল। তার বিজ্ঞান গবেষণার কাজও অনেকটা থমকে গেছিল। প্রায় টানা চার বছর সন্ন্যাসীর মতো নিজেকে সমস্ত কিছু থেকে সরিয়ে রাখেন। সামান্য কয়েকটি গবেষণা পত্র লিখেছিলেন এই সময়ে। অধিকাংশই ছিল অপ্র
কাশিত। 
এরপর ১৯৩৭ সালে তিনি আবার গবেষণা শুরু করেন। ইউনিভার্সিটি অফ নেপলসে ত্বাত্তিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এই সময় তিনি তার শেষ গবেষণাপত্রটি লেখেন। ইলেকট্রন ও তার অ্যান্টি পার্টিকেল পজিট্রনের ওপর। এই ম্যাটার আর অ্যান্টি ম্যাটারের ওপর কাজটিই তার শেষ প্রকাশিত কাজ ছিল।কিন্তু তারপরই দুম করে হারিয়ে গেলেন তিনি। আর সেই যে গেলেন তো গেলেন, কেউ তার খোঁজ পেল না।



**********

দিনটা ছিল ২৫শে মার্চ ১৯৩৮ সাল, পালেরমো থেকে নেপলস যাচ্ছিলেন তিনি। ওই দিনই তাকে শেষ দেখা গেছিল। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যে তিনি পালেরমোতে কি করতে গেছিলেন?

কেউ বলেন তিনি এমিলিও সেগ্রের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। কিন্তু এমিলিও সেগ্রে তখন ক্যালিফোর্নিয়াতে ছিলেন। তার পক্ষে ইতালি আসা অসম্ভব ছিল। কারণ সেই সময় মুসোলিনি এমন একটি আইন তৈরী করেন যার ফলে প্রবাসী ইহুদিরা দেশে ফিরতে পারতেন না। ইহুদি এমিলিও সেগ্রের তাই তখন ইতালিতে থাকার কথায় নয়।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে পালেরমো যাওয়ার আগে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সমস্ত টাকা তুলে নেওয়া হয়। তবে কি তিনি পরিকল্পিত ভাবে অন্তর্হিত হয়েছিলেন ?
আবার ওই ২৫ শে মার্চেই তিনি নেপলস ফিজিক্স ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা আন্তেনিয় কারেলি একটা চিঠি পাঠান। চিঠির বক্তব্য অদ্ভুত ও অস্পষ্ট। তাতে মাইয়োরানা বলেছিলেন -

প্রিয় কারেলি

                  আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি যেটা কোন মতেই এড়ানো যাচ্ছিল না। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বার্থপরতা নেই আমার, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি আমার এই হঠাৎ অন্তর্ধানের সিদ্ধান্তের ফলে তোমার এবং ছাত্রদের অনেক অসুবিধা হবে। গত কয়েক মাসে তুমি আমায় সহানুভূতি ও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলে, আমাকে বিশ্বাস করে ছিল, তার সমস্ত কিছুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য আমার ক্ষমা করো। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, আমার কথা সবাইকে মনে করানোর জন্য, যাদের আমি জানতে পেরেছি তোমার ইন্সটিটিউটে এসে। আমিও তাদের সবাইকে মনে রাখব আজ রাত ১১টা পর্যন্ত, আর সম্ভব হলে তার পরেও। 

                                                                                                               ইতি            এত্তেরিও মাইয়োরানা


 এই চিঠি দেখেই কেউ কেউ মনে করেন মাইয়োরানা বোধহয় আত্মহত্যা করেছেন। কারণ রাত ১১টার উল্লেখ দেখে মনে হতেই পারে ওই দিন রাত ১১টার পর আর তিনি বেঁচে থাকেন নি।
কিন্তু অনেকেই আবার মনে করেন তিনি আত্মহত্যা করার মতো মানুষ ছিলেন না। আর যদি আত্মহত্যাই করেন তবে ব্যাঙ্ক থেকে সমস্ত টাকা তুলে নেবেন কেন? আসলে তিনি নিজে থেকেই অন্তর্হিত হয়েছিলেন।
এত্তেরিও মাইয়োরানার নিখোঁজ সংবাদ, ইতালিয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত



এত্তেরিও মাইয়োরানাকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? এই নিয়ে খবর বেরিয়েছিল ১৯৩৮ সালে ১৭ জুলাই লা ডোমিনিকা দেল কোরিয়ে নামক ইতালিয় সংবাদপত্রে
তার এই অন্তর্ধান সম্পর্কে ফার্মি বলেন, "এত্তেরিও খুব বুদ্ধিমান। সে যদি নিজেই গা ঢাকা দিয়ে থাকে তবে তাকে খুঁজে বের করতে কেউ পারবে না।"
কেউ কেউ মনে করেন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে বন্দি করে। সেই সময় বেনিটো মুসোলিনি নিজে এই রহস্য সমাধানে উদগ্রীব হন। এমনকি মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেন। পুরস্কার মূল্য ধার্য্য হয় ৩০ হাজার লিরা। কারণ অবশ্য তখন একটাই। সব দেশ তখন পরমাণু অস্ত্রের খোঁজ চালাচ্ছে। আর অনেকেই মনে করেন মাইয়োরানার যা বুদ্ধিমত্তা, তা দিয়ে তিনি পরমাণু বোমা বানাতে পারেন।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পরেও এফবিআই তাকে পাগলের মতো খুঁজেছে। এই সন্দেহে যে, কোন দেশ বা সংস্থা তাকে দিয়ে পরমাণু বোমা বানাচ্ছে কি না। । কিন্তু সব কিছুই ধোঁয়াশা।

এরপর ১৯৭৫ সালে ইতালিয় লেখক লিওনার্দো শাশা, মাইয়োরানার অন্তর্ধান সম্পর্কে একটি বই লেখেন। সেখানে তিনি দাবি করেন এত্তেরিও মাইয়োরানা আর্জেন্টিনা চলে যান। সেখানে গিয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বাকি জীবন কাটান। কিন্তু এমিলিও সেগ্রে এই মত খারিজ করে দেন। তাদের মতে এত্তেরিও মাইয়োরানা আত্মহত্যা করেছিলান।

 



*********

এত্তেরিও মাইয়োরানার অন্তর্ধানের ৭০ বছর পর  ২০০৮ সালে একটি অবাক করা ঘটনা ঘটে। ইতালিয় টেলিভিশনে 'কি লা'হ ভিস্তো' (কে একে দেখেছে) নামক একটি অনুষ্ঠান হত। সেখানে একটি পর্বে এত্তেরিও মাইয়োরানার সম্পর্কে বলা হচ্ছিল। হঠাৎ একটি ফোন আসে। ফ্রান্সেস্কো ফাসানি নামক এক ব্যাক্তি দাবি করে বসেন তিনি মাইয়োরানাকে দেখেছেন। ফাসানি বলেন, তিনি ১৯৫৫ সালে ভেনেজুয়েলা যান। সেখানে তিনি তার সিসিলিয়ান বন্ধু সিরোর সাথে ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাস থেকে ভ্যালেন্সিয়া যান। সেখানে কার্লো নামক এক আর্জেন্টিনিয় ভদ্রলোকের মাধ্যমে মিঃ বিনি নামে এক ব্যাক্তির সাথে আলাপ হয়। বিনি ছিল  শুভ্রকেশযুক্ত এক ভদ্রলোক, অনেকটা রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগছিল। সে ছিল অন্তর্মুখী ও উদাসী মানুষ। তার কথায় রোমান টান ছিল। আরও যে ব্যাপারটা ফাসানিকে আগ্রহী করেছিল, সেটা হল বিনি হাতঘড়ি পরেছিল জামার হাতার ওপরে, সচারাচর ঘড়ি হাতার নীচে থাকে। কিন্তু সম্ভ্রান্ত রোমান পরিবারে হাতার ওপর ঘড়ি পরা ছিল একটি রীতি। উল্লেখযোগ্য হল মাইয়োরানার ঠাকুরদাদা এক সময় ছিলেন ইতালির কৃষি মন্ত্রী এবং মাইয়োরানারা বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল।
ফ্রান্সেস্কো ফাসানি ভেনেজুয়েলাতে গাড়ির মেকানিক হিসেবে কাজ করতো। বিনির একটি হলুদ রঙের স্টুডবেকার গাড়ি ছিল। কিন্তু ফাসানির মতে বিনি এতটাই গরিব ছিল, যে তার মনে হয়ে ছিল বিনির কাছে শুধু গাড়িতে গ্যাসোলিন ভরার টাকাই আছে। গাড়ি সারাবার খরচের মতো টাকা নেই। তো ফাসানি সেই গাড়ির মধ্যে কিছু কাগজপত্র দেখতে পান। সেই কাগজ পত্রের মধ্যে ১৯২০ সালে কুইরিনো মাইয়োরানার লেখা একটা পোস্টকার্ড ছিল, যেটা না কি W.G. নামক কোন এক আমেরিকানকে লেখা। এছাড়া ফাসানি একটি নোটবই পান, যেটা নাকি বিভিন্ন অঙ্ক ও ফর্মুলায় ভর্তি ছিল।
এরপর কার্লো তাকে বলেন, এই বিনি আসলে হলেন বিজ্ঞানী মাইয়োরানা। কার্লোর সাথে বিনির নাকি আর্জেন্টিনায় দেখা হয়েছিল। তখন ফাসানি বিনির সাথে একটি ছবি তুলতে চান। কিন্তু বিনি নারাজ। এরপর একদিন বিনি ১৫০ বলিভার ধার চায় ফাসানির কাছে, তখন ফাসানি তার বদলে বিনির সাথে ছবি তুলতে চায়। পরবর্তীকালে ফাসানি ছবিটিকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু টিভিতে মাইয়োরানাকে নিয়ে দেখাতে তার মনে পড়ে সবকিছু ও সে ফোন করে জানায় টেলিভিশন অফিসে। এই ঘটনার পরে ইতালিতে শোরগোল পড়ে যায়।  মাইয়োরানার কেসটি নতুন করে খোলা হয়। আবার অনুসন্ধান শুরু হয়।
বাম দিকে ফ্রান্সেস্কো ফাসানির সাথে ডান দিকের ব্যাক্তিটি ইত্তেরিও মাইয়োরানা বলে দাবি করা হয়

অনেকেই এই ছবিটি দেখে এনাকে মাইয়োরানা বলেন, কারণ ডান পাশের ব্যাক্তিটির সাথে এত্তেরিও মাইয়োরানার বাবার বৃদ্ধ বয়সের ছবির সাথে সম্পূর্ণ মিলে গেছিল। সব মিলিয়ে যা দাঁড়িয়ে ছিল তা হল, এই যে, মাইয়োরানা ১৯৫৫ সালের কিছু আগে আর্জেন্টিনা থেকে ভেনেজুয়েলা যান। কিন্তু কেন আর্জেন্টিনা গেছিলেন, সেখান থেকে কেনই বা ভেনেজুয়েলা গেছিলেন তা জানা গেল না।


*********

এইসব ঘটনার দু বছর পর  ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ বলোনে-র অধ্যাপক জর্জো দ্রাগোনি নতুন কিছু তথ্য তুলে ধরেন।  তিনি এত্তেরিও মাইয়োরানার অন্তর্ধানের ওপরে অনুসন্ধান করছিলেন। তিনি সাইমন উইজেন্থালের একটি বই, 'জাস্টিস, নট রিভেঞ্জ' (১৯৯৯) এর থেকে ছবি দেখান।
জর্জো দ্রাগোনি
ছবিটি ১৯৫০ সালে তোলা হয়েছিল। ছবিটির ক্যাপশান ছিল 'নাজি হান্টার অ্যান্ড দা হলোকাস্ট সারভাইভার।' যেখানে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বুয়েনস আইরিস গামী একটি জাহাজে। সেখানে মাঝের ভদ্রলোকটিকে নাৎসি সেনানায়ক অ্যাডলফ ইচম্যান বলেছিলেন সাইমন উইজেন্থাল। কিন্তু পাশের দুজনের পরিচয় ছিল না। এখন দ্রাগোনি একপাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে এত্তেরিও বলে দাবি করছেন।
মাঝখানে মাথায় টুপি পরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি অ্যাডলফ ইচম্যান, আর ছবির বামদিকে কালো চশমা পরে যিনি তাকেই এত্তেরিও মাইয়োরানা বলে দাবি করা হয়


সেই ছবির সাথে এত্তেরিওর ছবির সম্পূর্ণ মিল পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি তথ্য স্পষ্ট হয় যে এত্তেরিও মেজেরানা আর্জেন্টিনা চলে গেছিলেন।
এই একই ছবি থেকে ইত্তেরিও মাইয়োরানার  কথা ২০১০ সালের ১৭ অক্টোবর 'লা রিপাবলিকা' নামক ইতালিয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সেখানেও ছবির বামদিকের ব্যাক্তিকে মাইয়োরানা বলা হয়। 'লা রিপাবলিকা' সংবাদপত্রের সাংবাদিক জোসেফ বরেলো ও আরও দুই তরুণ সাংবাদিকের সাথে একটি বই লিখেছেন, লা সেকন্দা ভিতা দি মাইয়োরানা (মাইয়োরানার দ্বিতীয় জীবন)।
 


*********


ইত্তেরিও কিভাবে হারিয়ে গেলেন, কোথায় গেলেন এই রহস্যের আজও সমাধান হয়নি। আরেক ইতালিয় সাংবাদিক অ্যাঞ্জেলো প্যারাটিকা দাবি করেন তিনি আর্জেন্টিনাতেই থেকে যান, সেখানে পাদ্রীর কাজ করতেন। তিনি ভেনেজুয়েলা যাননি। আবার কেউ কেউ দাবি করেন ৮০-র দশকে তাকে রোমের রাস্তায় দেখা গেছে। কিন্তু তিনি কোথায় তা সম্পর্কে নিশ্চিত কেউ কিচ্ছু বলতে পারেনি।

লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের অধ্যাপক জোয়াও ম্যাগুইজো এই নিয়ে অনেক অনুসন্ধান করেন। তিনি ইত্তেরিওর বাড়ি গিয়েও তদন্ত করেন, সেখান থেকে তিনি কিছু অপ্রকাশিত গবেষণা পত্র পান। যযার মধ্যে ছিল কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স এর ওপর গবেষণা। যে কাজের জন্য ১৯৬৫ সালে নোবেল পান রিচার্ড ফাইনম্যান।
যদি সত্যি সত্যি তিনি তার সমস্ত গবেষণা প্রকাশ করতেন তবে তিনি একাধিক নোবেল পেতে। জেমস চ্যাডউইক থেকে রিচার্ড ফাইনম্যান- এদের সবার আগেই গবেষণায় এগিয়ে ছিলেন এত্তেরিও মাইয়োরানা। এনরিকো ফার্মি কোন ভুল বললেননি , এত্তেরিও মাইয়োরানা ছিলেন সত্যিকারের এক জিনিয়াস।
                                                               

Tuesday 3 July 2018

পাঠ পরবর্তী ভাব - তারাভরা আকাশের নীচে - শ্রীজাত



কোন কবি যখন গদ্য লেখেন, তখন তা স্বাদু গদ্য হয়ে ওঠে। আর চার-পাঁচ জন গদ্য লেখকের থেকে ভিন্ন। তেমনই এক উপন্যাস 'তারাভরা আকাশের নীচে'। গল্প শুরু হচ্ছে ১৮৮৮ সালের এক শীতসন্ধে থেকে, যখন আর্লে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের সাথে দেখা করতে আসছেন পল গগ্যাঁ। তিনি যখন কড়া নেড়ে ঢুকে পড়লেন ভিনসেন্টের বাড়িতে, তার পাশাপাশি পাঠকও ঢুকে পড়লেন ভিনসেন্টের আশ্চর্য দুনিয়ায়। যে ভিনসেন্ট চলে এসেছে প্যারিস ছেড়ে, কারণ ঘিঞ্জি প্যারিস তার ভাল লাগছিল না। কোথাও একটা তার মধ্যে নগর সভ্যতা থেকে পালানোর মনোবৃত্তি কাজ করছে।   আর তার সাথে প্রবল এক উন্মাদনা কাজ করছে ভিনসেন্টের মধ্যে। যার জন্য হঠাৎ করে অপমান করে বসেন পল গগ্যাঁকে। সেই উন্মাদনা থেকে কেটে ফেলেন নিজের কান। তারপর সেই রক্ত মাখা কান কাগজে মুড়িয়ে তুলে দেন গণিকার হাতে। এদিকে তাঁর সমস্ত পাগলামি সহ্য করে , তাকে মন প্রাণ দিয়ে সাহায্য করছে তাঁর ভাই থিও ভ্যান গঘ। ভিনসেন্টের জীবনে সে হল পরিবার ও ভিনসেন্টের মাঝে একমাত্র যোগসূত্র।
পাশাপাশি সামন্তরাল ভাবে গল্প এগোতে থাকে ২০১৭ সালে এক বিজ্ঞাপন জগতের কর্মী ঋত্বিকের জীবন ঘিরে। সে আঁকিয়ে হতে চেয়েছিল কিন্তু বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা আর বাড়ির চাপে সে সিধান্ত বদল করে। এছাড়া ঋত্বিক আর তাঁর ভাইয়ের সম্পর্ক ও ভাইয়ের অতীত স্মৃতি এসব তাড়া করে বেরায় তাকে। সব মিলেয়ে মধ্য তিরিশের ঋত্বিক হ্যালুসিনেশনে ভুগতে থেকে। মাঝে মধ্যেই কল্পনার জগতে চলে যায়। তার সব থেকে প্রিয় ছবি 'দ্য স্টারী নাইট'। এসব সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হতে থাকে তাঁর স্ত্রী শর্মিলা। তাকে নিয়ে যায় সাইক্রিয়াটিস্ট রুখসার আহমেদের কাছে। কিন্তু ঋত্বিকের সমস্যা মেটে না।
   

আসলে গল্প বলা এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য নয়। একজন শিল্পীর মধ্যে যে শৈল্পিক উন্মাদনা কাজ করে , যে উন্মাদনা তাঁর কল্পনাকে চাগিয়ে রাখে, সেই উন্মাদনার সাথে বাস্তবটা মেলে না। বা বলা ভাল আর চার-পাঁচ জন যেটাকে বাস্তব বলে দাগিয়ে দিতে চায় সেই বাস্তবের সাথে। যে দ্বন্দে দীর্ণ ভিনসেন্ট ও ঋত্বিক, দুজনেই। আসলে আমরা সাদা চোখে যেটাকে দেখি সেটাকে বাস্তব বলে মেনে নিই। আর যখন অন্য কেউ অন্য কোন ভাবে জগৎকে দেখে সেটাকে আমরা কল্পনা বলে দিই। আসলে বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শুধু আলাদা ভাবে দেখা। কিন্তু জগতের নিয়মে, বলা ভাল গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের নিয়মে যখন সেই আলাদা দেখা তাকে আমরা উন্মাদনা বলে দেগে দিই, তখন সেই ভিন্ন ভাবে ভাবুক মানুষগুলো আমাদের ঠিক করে দেওয়া বাস্তব আর কল্পনার মাঝখানে আটকা পড়ে যায়।
এই মানুষগুলো রাজা সিসিফাসের মতো, যার তেজ সবাই সহ্য করতে না পেরে তাকে সারা জীবন পাথর বইতে দিয়েছিল। যাতে তাঁর তেজ কমে যায়। আমরাও সেরকম এই মানুষগুলোকে শাস্তি দিয়ে ফেলি। আর এরাও তা থেকে পরিত্রাণ পায় না। সিসিফাসের মতো এরাও সারা জীবন এক অস্বস্তির পাথর বয়ে নিয়ে চলে তাঁর গোটা জীবন ধরে। কোন এক সময় সেই ভার অসহ্য হলে এরা থেমে যায়, আর তাতেই এদের মুক্তি। তাতেই এদের প্রকৃত বেঁচে থাকা।
এই উপন্যাসে দুটি মানুষের দুটি সামন্তরাল গল্প যেন বহতা নদীর মতো। তির তির করে বয়ে চলেছে, এক অদ্ভুত সুন্দর ফ্লো আছে এই উপন্যাসে। একদম শেষে গিয়ে দুই নদী সুন্দর ভাবে মিলে যায়। আর  পাঠক, যে কবির হাত ধরে সওয়ার হয়েছিল নদী ভ্রমণের নৌকায়, সেই নৌকা ছেড়ে যাওয়ার পর দুলুনি রয়ে যায় তার মনের শরীরে। সেই দুলুনি নিয়েই শেষ করতে হয় উপন্যাসটি। উপন্যাসের শেষে পাঠক পড়ে থাকেন, এক মোহনায় , যেখানে বাস্তব ও কল্পনার নদী এসে মিলেছে। যেখানে তাদের মধ্যে কোন ভেদ নেই, আছে শুধু মিল। যে গন্তব্যে যেতে চায় ভিনসেন্ট ও ঋত্বিক।


পুনশ্চঃ সম্প্রতি স্বপ্নসন্ধানী তারাভরা আকাশের নীচে উপন্যাস থেকে তারায় তারায় নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে চলেছে। নাটকের নির্দেশনায় কৌশিক সেন। চমকের ব্যাপার ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চরিত্রে অঞ্জন দত্ত। এছাড়া ঋত্বিকের চরিত্রে ঋদ্ধি সেন, শর্মিলার চরিত্রে সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রুখসার আহমেদের চরিত্রে রেশমি সেন। নাটকের আবহ ও সঙ্গীত পরিচালনায় নীল দত্ত। আশা করছি একটি দুর্দান্ত নাটক দেখতে পাওয়া যাবে। সেই আশায় রইল বাংলার নাট্যপ্রেমী মানুষ। 

আমার রবীন্দ্রনাথ - দ্বিতীয় পর্ব

আমাদের প্রাইমারী স্কুলের পাঠ্য বইয়ে রবীন্দ্রনাথের গল্পসল্প থেকে একটা গল্প ছিল - দাঁড় ও পাল। মূল গল্প 'বড় খবর'-এর প্রথমাংশটা।   তখন সেই সময় গল্পটা আমার বেশ মজার লেগেছিল। মানে ছোটবেলায় আমার ভাল লাগা রবীন্দ্রনাথের একমাত্র গল্প বলা যায়। তখন অবশ্য গল্পটার আভ্যন্তরিন অর্থ বুঝিনি। বাবা বলেছিলেন গল্পটা নাকি দারুণ। আমি অতশত বুঝিনি ভাল লেগেছিল ব্যাস। আমার দাঁড় ও পালের মধ্যে ঝগড়াটা বেশ মজার লেগেছিল।

রবীন্দ্রনাথের গল্প প্রথম উপলব্ধি করি হাই স্কুলে উঠে। আমাদের প্রধান পাঠ্য বইয়ের সাথে একটা করে সহায়ক পাঠ বই থাকত। তো সেই সহায়ক পাঠেই 'ছুটি' গল্পটা ছিল। আর গল্পে ফটিকের বয়স আমাদের তখনকার বয়সের মতোই। এই বয়স শৈশব ও যৌবনের মাঝামাঝি পর্যায়। ওই সময়ের অবস্থাকে এত সুন্দর করে যেন কেউ আর বলেনি। পড়লেই মনে হত আরে এতো আমারও কথা।

"তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই । শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না । স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে । তাহার মুখে আধো-আধো কথা ও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্ৰগলভতা ......... তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায় ; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মৰ্মে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবাৰ্য ক্রটিও যেন অসহ বোধ হয় ............  এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিম্বা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না ; কারণ সেটি সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে । "

মনে হয়েছিল, সত্যি তো এভাবে কেউ আমার জন্য কোনদিন বলেনি তো। কোথাও একটা মনের ভিতরে রবীন্দ্রনাথ জায়গা করে নিলেন, মনে হল এ বড় আপনার জন, এ আমার রবীন্দ্রনাথ।  আর কারও নয়। যে কথা কাউকে বলা যায়না, তিনিই যেন বলে দিয়েছেন সে কথা। আমাকে মুখ ফুটে অনুযোগ করতে হয়নি। সবচেয়ে মনে ধরেছিল এই কথাটা -  "এই বয়সে সাধারণত নারীজাতিকে কোনো-এক শ্রেষ্ঠ স্বৰ্গলোকের দুর্লভ জীব বলিয়া মনে ধারণা হইতে আরম্ভ হয়, অতএব তাহাদের নিকট হইতে উপেক্ষা অত্যস্ত দুঃসহ বোধ হয়।"   মোক্ষম লেগেছিল এই জায়গাটা।

পরে ভেবে দেখেছি কিশোর সাহিত্য অনেকে লিখেছেন। হয়তো আরও লিখবেন, কিন্তু এভাবে একটি কিশোরের মনোভাব তুলে ধরতে। অন্যরা কিশোরদের জন্য লেখা বলতে হয়  রহস্য রোমাঞ্চ বুঝেছেন না হলে 'হও ধরমেতে বীর'-মার্কা গল্প।  কিন্তু কিশোররা কি চায় তা বুঝতে চাননি। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, তাই তো তিনি রবীন্দ্রনাথ। হয়তো আজ - রবীন্দ্রনাথকে কেন ভাল লাগে - জিজ্ঞেস করলে বলব অন্য কোন কারন, কিন্তু সেই সময় জিজ্ঞেস করলে বলতাম 'ছুটি'।
সেই সময়ের পর থেকে রবীন্দ্রনাথের সাথে এক অভেদ্য সম্পর্কে যেন জড়িয়ে পড়ি। তারপর থেকে যেখানে আর কোন ভাঙ্গন ধরেনি।





 আমার রবীন্দ্রনাথ - প্রথম পর্বের লিঙ্ক

Sunday 1 July 2018

আমার রবীন্দ্রনাথ - প্রথম পর্ব


                       ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির 
                      পাঁচ বোন থাকে কালনায়,
                     শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়,
                       হাঁড়িগুলো রাখে আলনায়।

ছোটবেলায় 'ছড়ার মজা' বলে আমাকে একটা বই কিনে দেওয়া হয়েছিল। উপরের কবিতার লাইনগুলি বইটার প্রথম কবিতার প্রথম চার লাইন। ছোট্ট বইটা ছিল এমনই সব মজার কবিতায় ভরা। বই এর লেখক শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর এভাবেই আমার সাথে প্রথম আলাপ সেই গল্পদাদুর। হ্যাঁ দাদুই বটে, ছবিটা প্রথম দেখে শুধু আমার কেন যে কোন বাচ্চাই সেটা মনে করবে। যেন কোন রূপকথা দেশের লোক। ইয়া লম্বা দাড়ি, আর পা থেকে মাথা অবধি জোব্বা পড়ে আছেন। সব কিছুর মধ্যে যেন মুখটা ছোট্ট করে দেখা যাচ্ছে, বলা ভাল উঁকি দিচ্ছে যেন। তখন আমার বয়স তিন কি চার, তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি।
এরপর আর সমস্ত বাঙালি শিশুর মতোই আমিও স্কুলে গেলুম, আর হাতে পেলুম সহজ পাঠ।
                   ছোট খোকা বলে অ আ 
                শেখেনি সে কওয়া।


ধীরে ধীরে পাঠ এগোতে থাকল। ক্লাস ২এর পর আমরা আর সহজ পাঠ পরিনি, কিন্তু সেই স্মৃতি গুলো মনে থেকে গেছে। এবার একটা মজার কথা বলি। সহজ পাঠের প্রথম দিককার কবিতা গুলো বেশ ছন্দ মিলিয়ে পড়া যেত। পড়তে ভালোই লাগত। কিন্তু শেষের দিকে "ষ্টীমার আসিছে ঘাটে, প’ড়ে আসে বেলা" বলে একটা কবিতা ছিল। কিন্তু তখন সেই সব ছন্দ বুঝতাম না। শুধু জানতাম লাইনের শেষে এসে থামতে হয়। আর এতেই হতো বিপত্তি। কবিতাটা পড়লে এই রকম শোনাত। “শূন্য হয়ে গেল তীর আকাশের কোণে / পঞ্চমীর চাঁদ ওঠে দূরে বাঁশবনে / শেয়াল উঠিল ডেকে মুদির দোকানে।” অবাক হয়ে যেতাম। কি রকম বোকা বোকা লাগত আমার। আর এদিকে দাড়ি কমা অনুযায়ী থামলে তাতে মানে হত, কিন্তু ছন্দ পেতাম না ঠিক। ভাবতাম কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। এখন এই কথা গুলো মনে পড়লে বেশ হাসি পায়।
         

পৃথিবীতে হয়তো অনেক প্রাইমার আছে। বাংলা ভাষাতেও আছে আরো। কিন্তু সহজ পাঠ কোথাও একটা আলাদা। মনের অনেক ভিতরে।
এরপর ক্লাস এগিয়েছে, একটু একটু করে বড় হয়েছি। প্রতি ক্লাসেই অন্তত একটা করে রবীন্দ্রনাথের পদ্য ও গদ্য থাকত। তবে শুধু পাঠ্য বইয়েও নয়, তার বাইরেও রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা পড়েছিলাম। তখন আমাকে বাড়ি থেকে আরও দুটো কবিতার বই কিনে দেওয়া হয়েছিল - 'শিশু' আর 'শিশু ভোলানাথ'। তবে সব কবিতা গুলো যে পড়তাম তা নয়। যেগুলো ভাল লাগত, সেই গুলোই বারে বারে পড়তাম। তারমধ্যে শিশু বইটা থেকে 'মাস্টারবাবু' কবিতাটা বেশ প্রিয় ছিল। কবিতাটা এতবার পড়েছিলাম মুখস্ত হয়ে গেছিল।
তবে এছাড়াও কিছু কবিতা মুখস্ত করতে হয়েছিল। স্কুলে পরীক্ষার জন্য আর পাড়ায় রবীন্দ্র জয়ন্তীর জন্য। তখন রবীন্দ্র জয়ন্তী ছিল আমার কাছে বেশ একটা উত্তেজক ব্যাপার-স্যাপার। তবে একটা জিনিস কবিতা বলব, মঞ্চে উঠব এটা নিয়ে বেশ আনন্দ থাকেলেও আসল মজাটা টের পেতাম মুখের সামনে মাইকটা পাওয়ার পর। বার বার মনে হত এই যদি ভুলে যাই। তবে আমার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল, মানে এখনও আছে আর কি। আমি কবিতা বলাকালীন কবিতা থেকে কিছু শব্দ মুছে দিয়ে নিজের মতো কিছু শব্দ বসিয়ে নিতাম। এতে একটা জিনিস হত, মঞ্চে বলার সময় ঘাবড়ে যেতাম না। কিন্তু সমস্যাটা হত এর পরে। ভীষণ বকা খেতাম আরকি। কারণ রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা গুলো কম বেশি সবার জানা। ফলে ফাঁকি দেওয়ার কোন উপায় ছিল না।
শিশু ভোলানাথ বইটা থেকে একটা কবিতা আমার বেশ ভাল লাগত - খেলা ভোলা। কবিতাটা অবশ্য সহজ পাঠেও ছিল। কবিতার লাইন গুলো পড়লেই কি রকম চোখের সামনে ছবি ভেসে উঠে।
 শীতের বেলায় দুই পহরে
দূরে কাদের ছাদের ’পরে
ছোট্ট মেয়ে রোদদুরে দেয়
 বেগনি রঙের শাড়ি।
Related image
শিশু ভোলানাথের আরেকটা কবিতাটার সাথে নিজের মনের কথাটা খুব মিলে যেত। সেটা হল রবিবার কবিতা। সত্যি আমিও ওই রবিবারের জন্য সারা হপ্তা অপেক্ষা করেতাম, আর আমারও এটাই মনে হত 
  সোম মঙ্গল বুধ এরা সব
          আসে তাড়াতাড়ি,
এদের ঘরে আছে বুঝি
          মস্ত হাওয়া - গাড়ি?
রবিবার সে কেন, মা গো,
           এমন দেরি করে?

এই ভাবে আমার একদম ছোটবেলা জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে শুধু কবিতাও নয়, আমার গানও ভাল লাগত। অবশ্য এ ভাল লাগা মানে সুর বা ছন্দটা ভাল লাগা, কথা বোঝার মতো বয়স হয়নি। এর মধ্যে একটা গান ছিল, আমরা সবাই রাজা। এই গানটাতে আমি ছোটবেলায় একটা দলবদ্ধ নৃত্যনাট্যে নেচেছিলাম। সেই সুরটা বড় ভাল লেগেছিল। আর একটা গানের ছন্দটা বেশ ভাল লাগে, গানটা কেউ না থাকলে মনের আনন্দে একা একা গাইতাম। অবশ্য সুর মিলত না। সেটা হল-
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥
হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ--
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥

তবে একটা জিনিস এই সময়টায় সেভাবে রবীন্দ্রনাথের গদ্যের দিকে আকর্ষিত হয়নি। কেন জানি না ওই সহজ পাঠের পর রবীন্দ্রনাথের গদ্য আর ছোটবেলায় সেভাবে পড়া হয়নি। ওই দশ-বারো বছর নাগাদ কে একটা গল্প গুচ্ছ উপহার দিয়েছিল। কে দিয়েছিল মনে নেই, তবে জন্মদিনের উপহার এটা মনে আছে। সেখান থেকে তখন কটা গল্প পড়েছিলাম। প্রথম গল্প পড়েছিলাম ক্ষুদিত পাষাণ। এক দাদা বলেছিল ভাল গল্প, কিন্তু পড়ে আমার ভাল লাগেনি তখন, আসলে ওই বয়সে ওটা পড়া ঠিক হয়নি, কিন্তু তখন অতশত বুঝতাম না। আর এটা পড়ার পর আমার একটা ধারণা হয় যে রবীন্দ্রনাথ কবিতাই ভাল লেখেন, আর উনি তো বিশ্বকবি, কবিতাই লেখা উচিত। খামোকা কেন যে গেলেন গল্প লিখতে, কে জানে বাবা।  তবে এ ধারণাও ভেঙ্গেছিল আর দু-এক বছর পরই। সে গল্প বলব পরের পর্বে। আজ এটুকুই থাক।


আমার রবীন্দ্রনাথ - দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক 

Wednesday 20 June 2018

আমার ডোরেমন চাই




বহুদিন আগের কথা। তখন খুবই ছোট। ক্লাস টু কিম্বা থ্রিতে পড়ি। আমাদের বাড়ির পুরানো টিভির বদলে একটা নতুন টিভি কেনা হয়েছিল। তাছাড়া আগের টিভিটা এমনিতেই খারাপ হয়ে গেছিল। নতুন টিভি আসতেই আমার আর আনন্দ ধরে না। আগের টিভিটায় অনেক কম চ্যানেল আসত। এটায় অনেক বেশি। তখনও ডিশ বা সেটটপ বক্সের যুগ আসেনি। ফলত আজকের মত হাজারখানা চ্যানেল ছিল না, কিন্তু যা আসত তা অনেক। ধীরে ধীরে ডিসনি, পোগো, কার্টুন নেটওয়ার্কের সাথে পরিচয় হয়েছিল। খুলে গেছিল এক অবাক দুনিয়া।
যারা নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে জন্মেছে তারা ব্যাপারটা ভাল বুঝবে। আসলে মুক্ত অর্থনীতির হাওয়া আর প্রযুক্তি বিপ্লবের ছোঁয়া সবে লাগতে শুরু করেছে আমাদের দেশে। টেলিভিশন ছিল তখন প্রধান বিনোদন। তো সেই কল্পনার দুনিয়ায় চিরকালীন টম অ্যান্ড জেরি ছাড়াও আরও এমন অনেক কার্টুন ছিল যা আজ আর সেরকম দেখতে পাওয়া যায় না। এর মধ্যে ছিল অসওয়াল্ড, নডি।
মনে আছে একদিন ডিসনি দেখতে দেখতে একটা কার্টুনের সন্ধান পাই। আগে অ্যাড দেখাতো দেখতাম, কিন্তু তার আগে কোনদিন দেখা হয়ে ওঠেনি। গল্পটা বেশ অদ্ভুত, একটা বাচ্চা ছেলে সে খালি সমস্যায় পড়ে, সে দুর্বল। আর তাকে সাহায্য করে এক ভবিষ্যতের এক রোবট। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন ডোরেমন। কেন জানিনা অল্পদিনের মধ্যেই কার্টুনটা বেশ পছন্দের হয়ে উঠেছিল। হয়তো কোথাও আমরাও নিজেদের জীবনে নবিতার মতোই। হ্যাঁ হয়তো আমরা ওর মতো অতটা বোকা নই, কিন্তু কোথাও আমরাও নিজেকে অনেকটা অসহায় মনে করি। সত্যি যদি এই রকম কেউ একটা ত্রাতা থাকত। আজ জানি এটা সম্ভব নয়, কিন্তু ভাবতে বড় ভাল লাগে। হয়তো আমাদের প্রত্যেকের জীবনের অপূর্ণ স্বাদগুলো পূরণ করতে এই রকম একটা কেউ এলে ভাল হত। সত্যিই তো কত স্বাদ অপূর্ণ থেকে যায়। অনেক সময় সেগুলো চাপা পড়ে যায় কিম্বা জীবনে চলেতে গেলে চাপা দিয়ে রাখতে হয়। হয়তো সে ইচ্ছা গুলো বড় তুচ্ছ, কিন্তু সেই মুহূর্তে ওগুলোই ছিল সোনার চেয়ে দামি। আর কোনদিন হয়তো সেগুলো পূরণ হবেনা। কত অপূর্ণ স্বাদ মনে পড়ে, সেই সুন্দর দেখতে রঙ পেন্সিলের বাক্স বা সেই মজার কমিক্সটা, দোকানে দেখেছিলাম, কিন্তু কোন কারণে কেনা আর হয়নি। আজও থেকে যায় অনেক ইচ্ছা মনের গভীর স্থানে। কোন এইরকম বন্ধু পেলে হত যে পূরণ  করতো  এইসব ইচ্ছা। আজও বড় হয়ে মনে হয়, ওই দিন গুলোতে ফিরে যাই। যদি পেতাম ডোরেমনের টাইম মেশিনটা। 
জীবনের সমস্যায় আজও পড়ি, ভবিষ্যতেও পড়ব। কিন্তু সে সমস্যা থেকে মনে মনে একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যায়, যখন সেই ছোট বেলার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। আসলে আমরা প্রতেকেই বাঁচি সেই শৈশব স্মৃতির অন্বেষণ করে। এই শৈশব স্মৃতিটায় হয়তো ডোরেমন, যা ক্ষণিকের জন্য হলেও বাস্তবটাকে ভুলিয়ে মনটাকে ভাল রাখে, শক্তি যোগায় আবার নতুন করে কাজে ঝাঁপানোর। ডোরেমন কোনদিন হারতে শেখায়নি। শত বিপদের মধ্যেও নবিতাকে সে বাঁচতে শিখিয়েছে। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, অমর্ত্য সেন বলেছেন ফার্স্ট বয়দের দেশ। যেখানে সব রোশনাই ফার্স্ট বয়দের নিয়ে। তারা বড় ইন্সটিটিউশনে পড়বে, সম্মান পাবে, আর শিক্ষান্তে যাদের অধিকাংশ দেশ ছাড়বে কারণ এখানে সেরকম প্রস্পেক্ট নেই। কিন্তু এদেশে পড়ে থাকবে নবিতারাই। যারা পিছিয়ে পড়েছিল কিন্তু হারেনি। তাদের নিয়ে কেউ সেলিব্রেট করেনি, তবুও তারা আছে। আর তাদের জন্য আছে ডোরেমনরা আশা ভরসা যোগাবে তাদের। 
তাই আজও ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠি এই বলে - যে আমার ডোরেমন চাই।
আর মন বলে এই তো আমি, কেন কাঁদ বন্ধু আমি তো ছেড়ে যায়নি। আমরা এক সাথে ভবিষ্যতটা দেখব। একসাথে হাসব। এই তো আমি।
সত্যি এই জন্যই আমার ডোরেমন চাই। 

Thursday 14 June 2018

ইতিহাস ও আমি

মনে পড়ে সেই সময়ের কথা, মাধ্যমিকের রেসাল্ট বেরিয়েছে সদ্য। রেসাল্টটা বেশ ভালই হয়েছিল, অন্তত লোকে তাই বলেছিল। সারাদিন স্তুতি বাক্যশুনে মুখের মধ্যেও একটা হাসি খেলে গেছিল কোথাও। চেষ্টা করেছিলাম মুখটাকে যথা পূর্বক গম্ভীর রাখতে, কিন্তু পারিনি। যাক গে স্কুলে গেলাম তারপর আসল রেসাল্টটা আনতে। সেখানে গিয়েই তারপর স্যরেরা অনেকেই ভাল বলল, আর তারপর যে প্রশ্নটা ছুটে এল সেটা হল, সাইন্স নিচ্ছ তো? এটা একটা ব্যাধি কি না জানিনা, কিন্তু এ বঙ্গে ছেলে মেয়েরা রেসাল্ট ভাল করলে তাকে সাইন্স নিতেই হয়, নাহলে মান থাকে না। আমি অবশ্য কোনদিন মানের কথা ভাবিনি। তবুও সাইন্স নিয়েছিলাম। অবশ্য সাইন্স নেওয়ার প্রস্তুতি মাধ্যমিকের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই নিতে হয়েছিল। মানে সবাই নেয় আরকি। তবে পরীক্ষার পর এ নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করেছিলাম। কি নেব? কি পড়ব? তা শেষ পর্যন্ত গড্ডলিকা প্রবাহেই গা ভাসিয়েছিলাম।

এরপর এসে গেছিল সেই ভর্তির দিনটা। নিজের স্কুলেই দ্বিতীয়বার আবার ভর্তি হলাম। সেদিন খুব মজাও হয়েছিল। কিন্তু ভাবনাটা তখনও যায়নি, ঠিক করলাম তো? পারব তো?

একজনই মাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছিল শুধু, তাও সেটা অনেক পরে অবশ্য, কিন্তু করেছিল। আমার এক সহপাঠীর ভাই, নাম অভিজ্ঞান। ও আমাদের স্কুলেই পড়ত, আমার থেকে কয়েক ক্লাস নিচুতে। তো স্কুলেই দেখা হতে ও প্রশ্ন করে, সবুজ দাদা তুমি ইতিহাস নাওনি?

ইতিহাস - আমার প্রিয় সাবজেক্ট কি না জানিনা, কিন্তু বেশ ভালোই লাগত পড়তে। মাধ্যমিকে ইতিহাসে ৯৫ পেয়েছিলাম, এখনও মনে আছে। এখনকার মত এত এমসিকিউ প্রশ্ন থাকত না তখন, ফলে নম্বরটা তোলা সহজ ছিল না। বড্ড ভাল লাগত পড়তে। অনেকে ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক কথা বলে, যে বাজে সাবজেক্ট। কোন লজিক নেই, শুধু সাল তারিখের সালতামামি। কিন্তু আমার বড় ভাল লাগত, কি সুন্দর গল্পের মত একটা জিনিস। তবে সত্যি কথা বলতে কি, লজিক সব জায়গায় খোঁজা যেত না, আর খুঁজতামও না। শুধু জীবন আর চারপাশের সাথে মিলিয়ে দেখতাম মিলছে কি না। মিললে বুঝতাম ইতিহাস ঠিক। না মিললেই প্রশ্ন তুলতাম। আসলে ইতিহাসের গল্প গুলো পড়তে পড়তে কোথাও একটা হারিয়ে যেতাম, মন যেন টাইম মেশিন হয়ে যেত। মনে হত এই তো আনন্দ, এটাই জগৎ।

আমার এক মাসতুতো দিদির একটা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ইতিহাস বই ছিল, বইটা নিয়ে এসছিলাম পড়ব বলে। পড়েও ছিলাম পুরোটা।

আমার ইতিহাস মানে কিন্তু শুধু প্রাচীন কালের রাজারাজড়া নয়, আধুনিক ইতিহাসও ভাল লাগত। যাতে রোমান্টিসিসম কম, আর ক্রুরতা বেশি। কিন্তু কি জানি, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন গুলো কি রকম থ্রিলিং লাগত। লোকে আজকাল পলিটিকাল থ্রিলার পড়ে, কিন্তু আমার কাছে ওগুলোই থ্রিলার ছিল। তবে একটা ব্যাপার, আমি ইতিহাস কে কোন দিন একদিক দিয়ে দেখিনি, মানে ওই পরীক্ষার আসা প্রশ্নের মতো, যেমন বলা হত আকবর কেন মহান, গুপ্তযুগকে কেন স্বর্ণযুগ বলা হয়, এই রকম আরকি। আমার কাছে মহানত্বের থেকে বড় ছিল সত্যিটা। মানে যেটা বলা হয় সেটা সত্যি কি না। এর জন্য অনেক বইও পড়তাম, সব বুঝতাম না অথচ পড়তাম। গল্পের মত পড়তে ভালই লাগত। আমার কাছে ওগুলো গল্পের বইয়ের মত ছিল। আসলে আমার মনে হয় আমার শুধু একার নয়, ওই সময় আমাদের স্কুলের দীর্ঘ সময় ধরে পরপর কয়েকটি ব্যাচের কিছু সংখ্যক ছেলেদের মনে ইতিহাস বাসা বেঁধেছিল। তার একটা কারন ছিল, আমাদের স্কুলের একজন ইতিহাস শিক্ষক, নন্দন কুমার বসু। তিনি অবশ্য ইতিহাস নিয়ে পড়তে চাননি না কি কোনদিন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তাকে ইতিহাস নিতে হয়, আর সেই লোকটিই ইতিহাস-প্রীতি ধরিয়েছিলেন বছরের পর বছর হাজার ছাত্রের মনে। তবে আমার ইতিহাস-প্রেম শুধু ওই কারণেই ধরেছে এটা বললে অত্যুক্তি হবে। আসলে আমার মধ্যে জানার একটা উদগ্র বাসনা ছিল, মানে আজও আছে। যা কিছু অজানা স-অ-অ-ব জানবো। অনেকটা অভিযাত্রীর মতো, বইয়ের থেকে তার বাইরের জগতে আকর্ষণ বেশি ছিল, আছে থাকেবে। কোন একটা বিষয় নিয়ে থেমে থাকতে ভাল লাগে না। কিন্তু সমস্যা হল আমি তো আর অসীমপ্রতিভা ধর নই, তাই সব কিছু পড়া সম্ভব হল না। একসাথে তাল দিতে পারলাম না। কিন্তু ইচ্ছা, সেটা যাবে কোথায়। মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দিয়েছে। যতবার ইলেভেন-টুয়েলভে ক্যালকুলাস নিয়ে সমস্যায় পড়েছি, অঙ্ক কিছুতেই মাথায় ঢোকেনি, বারবার মনে হয়েছে ছুটে যায় ইতিহাসের কাছে। আজকাল তো আর্টসে নম্বর পাওয়া সোজা হয়ে গেছে, গেলেই ভাল হত। এই মনে হয়েছে বারবার। কিন্তু যেতে গিয়েও পারিনি। প্রথমত নিয়মের বেড়াজালে, আর তার থেকেও বড় হল জীববিদ্যার মায়া কাটিয়ে যাওয়া। আসলে ইতিহাসের মতো এও আমার আরেক ভাললাগা। আর একেও লোকে কম দুর্নাম দেয় না। এটাও মুখস্ত করার বিষয় বলে কি না লোকে তাই। তা লোকের কথায় কান দেই নি, কিন্তু তা বলে ইতিহাসের অমোঘ আকর্ষণ এড়াতেও পারিনি। তবে এই দ্বন্দের মাঝে একটা কাজ হয়েছে, এর মাধ্যেমে আমি বুঝে গেছিলাম আমি কি চাই। আসলে আমার স্বপ্নটা একজন পলিম্যাথ হওয়ার। হ্যাঁ, পলিম্যাথ - অনেক কিছু জানে যে। ভেবে দেখলাম সত্যই তো তাই, বিজ্ঞানের পাশাপাশি পুরাণেও আগ্রহ আমার। সেই লক্ষেই এগিয়ে যেতে চেষ্টা করি, আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিলাম, যে বিজ্ঞান পড়লে ইতিহাস নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে চর্চা করাই যায়। কিন্তু উল্টোটা হয় না, কেন জানি না এ এক অদ্ভুত নিয়ম। দেখবেন অনেক কবি সাহিত্যিক বিজ্ঞানের লোক। কবি নিকোনা পাররা ছিলেন অঙ্কের অধ্যাপক, আলেকজান্ডার সলঝেনিতসিনও ছিলেন অঙ্কের লোক। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম এটা জেনে। যে বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ন আহমেদ রসায়ন বিদ্যার লোক ছিলেন। মনে মনে ভাবলাম, পলিমার নিয়ে পিএইচডি থিসিস লেখার পরও যদি কেউ অমন শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে, তো সবই সম্ভব। তারপর আস্তে আস্তে যখন আরও জানতে শিখলাম, অনেক লোকের সাথে পরিচয় হল তখন দেখলাম, যে অনেকেই বিজ্ঞানের লোক, কেউ আইটি ইঞ্জিনিয়ার, কিম্বা কেউ বিজ্ঞানী। তবুও এরা আপন খেয়ালে নিজের সৃষ্টিতে মগ্ন। আসলে বুঝলাম গোটাটাই এক, সৃষ্টি আর স্রষ্টার লীলা খেলা মাত্র। আমারা নিজের শুধু দাগিয়ে দিয়েছি, এটা ইতিহাস, এটা বিজ্ঞান, এই বলে। আবার চাইলাম ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখলাম, দেখলাম সত্যি তো এভাবে কেন দেখি না জীবনটাকে। সবটায় তো যুক্তিবাদী মনের খেলা, সে ইতিহাস পড়ি আর বিজ্ঞান। যুক্তি দিয়ে বিচার করাটায় আসল। ঐতিহাসিকরা তো আসলে গোয়েন্দা, সূত্র ধরে ধরে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করে চলেছেন। আর বিজ্ঞানীরা এটাই করেন, পরীক্ষার ফল দেখে বোঝার চেষ্টা সত্যিটাকে। আসলে তো আমরা সবাই আবিষ্কারক, খুজে চলেছি অরূপ রতন জীবনের খনি থেকে, যে যার নিজের মতো করে। আস্তে আস্তে নিজেকে জানলাম। পুরো জানা কখনও যায় না, তাই অনুসন্ধান চলছে। ইতিহাস তো সেটাই যা অতীতচর্চার মাধ্যমে নিজেকে জানা। নিজের শিকড়কে জানা। তাই বারবার মন চলে  যার ইতিহাসের কোলে, মাথা রেখে ঘুমোতে ইচ্ছা করে, আর মনে হয় আবার সেই টাইম মেশিন চড়ে বেরিয়ে পড়ি মানস ভ্রমণে।

বহুদিন হল ব্যস্ত জীবনের ফাকে আর ইতিহাস পড়া হয় না, সেই যে পাঠ বন্ধ করেছিলাম আর খোলা হয় নি। খুলব একদিন, খুলতে হবেই, এই আশা নিয়েই থাকি।

একদিন সত্যি ফিরে যাব ইতিহাসের কাছে।

Tuesday 12 June 2018

ভাগাড়ের মাংস ও বাঙালি

কদিন আগে চারিদিকে ভাগাড়ের মাংস নিয়ে হইচই পড়ে গেছিল। তা সেই দেখে একটা পুরাণের একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। একবার দুর্ভিক্ষের সময় বিশ্বামিত্র মুনি খাবার না পেয়ে চন্ডালদের বাসস্থানে ঢুঁ মেরেছেন। কিন্তু সেখানে ঢুকতেই চন্ডালরা তাকে চোর ভেবে ধরে ফেলে, এবার ধরে তো এই মারে তো সেই মারে। এমতাবস্থায় মুনি তো কোনক্রমে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে, অবশেষে তারা মুনির কথা শুনতে রাজি হয়। চন্ডালরা তার কথা শোনার পর তো তাকে পায়ে ধরে বাবা-বাছা বলে ক্ষমা চায়, এই যদি মুনিঋষি কোন শাপ দিয়ে দেন। কিন্তু মুনি শাপ দেবেন কি, তার পেটে তখন ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। উলটে তিনিই চন্ডালদের কাছে খাবার চেয়ে বসেন, একথা শুনে চন্ডাল বলে তারা তো কুকুরের মাংস খায়, এ মাংস কি মুনিবর খাবেন? মুনিবরের তখন যায় যায় অবস্থা। কিছু পেটে পড়লে বাঁচেন। তিনি বললেন - আরে তাই দাও, আমি মন্ত্রবলে কুকুরের মাংস অমৃত করে নেব।
তো তারপর বিশ্বামিত্র সেই কুকুরের মাংস মন্ত্রবলে অমৃততে পরিণত করেন, শুধু তাই নয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন, আর দেবতারা তা গ্রহণও করেন। তারপর সেই প্রসাদ সবাই খায়।
কে জানে আজকালকার রেস্তরার রাঁধুনিগণ হয়ত বিশ্বামিত্রের সেই ফর্মুলা জেনে গেছেন। আর তা দিয়েই কুকুরের মাংসকে অমৃত করে তুলছেন। তবে বাঁচোয়া এই যে আমাদের নেতাগণ এই পৌরাণিক কাহিনি জানেন না, জানলে আর রক্ষে থাকত না। গনেশের মাথার প্লাস্টিক সার্জারির মতো ভাগাড়ের মাংসের এই জাস্টিফিকেশন খুজে বের করতেন।
কিন্তু পুরাকালে না হয়, দুর্ভিক্ষ চলছিল। কিন্তু এখন তো সেরম কিছু ঘটেনি, তবুও আমবাঙালি ঘরের খাবার ছেড়ে দিয়ে ভাগাড়ের মাংসের দিকে চলছিল। কেউ কেউ বলবেন, এসবই পণ্যায়নের যুগের ফল। ওপরের চাকচিক্য দেখে সবাই ছুটছে, ভিতরে কি আছে দেখার দরকার পরে না।
তবে কি শুধুই তাই? তাহলে এরকম ঘটনা অন্য কোথাও ঘটছে না কেন? সরকারি প্রতিনিধিরা বলবেন, হয় হয়। জানতি পারো না। তারা আছেন বলেই এসব না কি ধরে পড়ছে, অন্য কোথাও হলে না কি সেটাই হতো না। কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট নিম্নমানের জিনিস বাঙালি খেয়ে চলছিল, অথচ যতক্ষণ না বাইরে থেকে বলা হল সে খাওয়া থামায়নি। শারীরিক স্বাস্থ্য ব্যাপারটা না হয় ডাক্তারি পরীক্ষায় মাপা যায়, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা মাপবে কে? খাদ্যরুচির মতো অন্যান্য রুচিও কি ডুবে যাচ্ছে। খেয়াল করবেন টিভির সান্ধ্য আড্ডার আসর গুলি। সেখানে একজনের মত অন্য জনের মতকে দাবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, যুক্তির ধার এনারা ধারেন না। যার গলার জোর যত, সেই জেতে। অথচ মানুষ এগুলোই রোজ গিলছে। আর বাংলা সিরিয়ালের কথা না বলাই ভাল। আরও ভাল বোঝা যায় বিভিন্ন ফেসবুকের লেখা থেকে। আজকাল তো সবাই সাহিত্যিক। তো দেখবেন নামী সেলিব্রিটির লেখা ছাড়া যেগুলো বেশি লাইক পায়, শেয়ার হয়, সেগুলো মূলত সস্তা প্রেমের গল্প, না হয় নিম্ন রুচির জোকস ও মিম। এটাই এখন ট্রেন্ড। ইউটিউব ভিডিও বানাতে চান, তো গুচ্ছের গালাগালি দিন আপনি ফেমাস হবেন।
মাঝে মাঝে মনে হয় সীস্যারোর মতো বলে উঠি "ও টেম্পোরা ও মোজ়"। তবে এটাও ঠিক এ জিনিস বাঙালির আজ নয়, চিরকাল হয়েই আসছে বলে বোধ হয়। হুতোম পেঁচার নকশায় দেখবেন, বাঙালির বাবু কালচারের বৃতান্ত। কতটা নিচে নামতে পারে রুচি। মাইকেল মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাই এ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। সপ্তকোটী বাঙালি আর মানুষ হল না বলে দুঃখ করেছেন।
তাই এ দেখেই ভরসা হয়, সব শেষ হয়ে যায়নি, আর যাবেও না। সেইকালে যদি এতকিছুর মধ্যেও ঐরকম সব বিখ্যাত সৃষ্টি হতে পারে, তো আজও হতে পারবে। আর সময়ে দাঁড়িয়ে সময়কে বিচার করা যায় না, আর আমিই বা কে বিচার করার।
তাই তো বলি সমাজ সমাজের মতোই চলবে, কিন্তু তার মধ্যে থেকেই সৃষ্টি হবে ভাল কিছুর, যেমন পাঁকে পদ্ম ফোটে।

এই ভরসা নিয়েই তো বেঁচে থাকা।
চলুক এ জীবন।

Thursday 7 June 2018

সন্ধ্যাবেলায় একলা ছেলে

ঝড় উঠেছে
বাড়ির টগর গাছটা প্রচন্ড জোরে দুলছে ,
পশ্চিমের আকাশটা আসন্ন প্রসবা মোষের মতো হয়ে আছে
জানালা দিয়ে বাইরে দেখি চারদিক যেন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে
হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল 
বিতনু ফোন করছে
জানি এটা বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলার আমন্ত্রণ
তাই ফোনটাকে বেজে দিতে দিলাম
ভাল লাগছে না কিচ্ছুটি
মনটা যেন গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের পর অবসন্ন বিকেল
মনও যেন একটা ঝড় চাইছে
ঝরা যত পাতা জমে আছে হৃদয়ের গভীরে
উড়ে যাক সবকিছু
জমাট বাঁধা অন্ধকারগুলো সব ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে
হঠাৎ একটা দুম করে শব্দ
মানুদের বাড়ির নারকেল গাছটা ঝড়ের তোড়ে ভেঙে পড়ল
কেন যে মনের অবাঞ্ছিত দেওয়ালগুলো এভাবে ভেঙে পড়ে না
তাই ভাবি মাঝেমাঝে
এমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল
আমার মনের কোনের ময়ূরটাও পেখম তুলেছে
এইবার ভাসিয়ে নিয়ে যাক তো মনের গহনের সব জমা জল আর কান্না
আজ ভিজতে ইচ্ছে করছে
এই বারিসিঞ্চনে যেন অঙ্কুরিত হোক নতুন সৃষ্টির বীজ
বৃষ্টির ছাটেতে ভিজে যাচ্ছে চোখ-মুখ
এক অদ্ভুত শীতলতা আবিষ্ট করছে হৃদয়কে
মনকে নাড়া দিচ্ছে নতুন কিছু স্বপ্ন
আকাশকে ছুঁতে চাইছে মাটির কাছে থেকেও ।
বৃষ্টি থেমে গেছে
সন্ধ্যা নেমে এসেছে
মা ডাকছেন
যাই এবার পড়তে বসি ।

স্বপ্ন সন্ধান

ওরে আজকে ডাক এসেছে
মেঘমল্লারের দেশ থেকে
তাড়িত ধ্বনি আর খুঁজবে না
হারিয়ে যাওয়া নিস্তব্ধতাকে
হাওয়ার তালে মাতবে আজ
এগিয়ে যাবে নীরবের নিরবচ্ছিন্নতাকে ছিন্ন করে
মনের গহন অরণ্যেতে
কাজলচোখা সেই হরিণী
ছুটে চলবে কল্লোলের কলরবে ।
আয় আজকে আমরা সবাই মিলে
ভাসাই চল কাগজের নৌকো
ফিরে যাই ছোট্টবেলায়
সাজাব ঘর নতুন করে
লুপ্ত হৃদয়ের বাঁশি যে আজ
বাজছে যেন নতুন সুরে ,
ওই দেখা যায় নীল আকাশ
সাজিয়ে কত মেঘের পসরা
সবার জন্য মেঘ আজকে
আনবে নতুন বারিধারা ।
সাঁঝবেলাতে উঠবে তারা
গল্প বলবে রূপকথার
লুকিয়ে থাকা দুঃখগুলো
জমবে না আর মনের ভিতর ।
তাই , আজকে হৃদয় মানছে না আর
কোনো বাধার বাধ্যবাধকতা
বলেছে যেন , আয় চলে আয়
সবাই মিলে খেলব মোরা
হারিয়ে যাওয়ার খেলাঘরে ।

Sunday 3 June 2018

পুনর্জন্ম

পুনর্জন্ম বলে কি কিছু আছে ? যদিবা থাকে বুঝব কি করে ? জানা যাবে কি করে যে এইটেই দ্বিতীয় জন্ম ? - এই রকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে টেবিলে মাথা রেখে চুপ করে বসে ছিল অমলকিশোর।
মাথার অপর সিলিং ফ্যানের ঘোরার আওয়াজ ছাড়া গোটা ঘর নিস্তব্ধ বলা চলে। ফ্যানটাও যেন সারাদিন চলে চলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঘুরছে বটে কিন্তু হাওয়া সেরম লাগছে না, আর লাগলেও তাতে গরম যাচ্ছে না। আজ অবশ্য গরম ছিল বেশ, বেলা থেকেই আকাশটা মেঘলা ছিল, কিন্তু বৃষ্টি আসেনি, একটু দমকা হাওয়া ছেড়েছিল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কিন্তু তাও সেই ক্ষণিকের জন্যই। ফলে কি রকম একটা গুমোট ভাব আছে এখনো।
অমলকিশোরের পুরো ব্যপারটাই এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। সে ভেবে দেখেছে যতক্ষণ মানুষের কোনো বড় সমস্যা থেকে তখন ছোট গুলো খুব একটা ম্যাটার করে না। যেমন যাদের পেটে খিদে - ওই ফুটপাত বাসী মানুষগুলো, তাদের কাছে দৈনন্দিন জীবনের পথ চলতি সমস্যা গুলো যেন সমস্যা নয়। এক তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দেয় যেন। কাল যদি তাদের অন্ন সমস্যা মিটে যায় তখন অন্য আরো সমস্যা শুরু হবে। সমস্যাও কি রকম আকাঙ্ক্ষার মতো, আকাঙ্ক্ষা যে রকম পূরণ হতে চায় না সমস্যাও সেরম ফুরোতে চায় না। তবে অমলকিশোর সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা না করে বিকল্প রাস্তা খুঁজে ফেরে সব সময়। তাই এখন ভাবছে যদি আবার সব নতুন করে শুরু করা যেত। অন্তত এই সমস্যা গুলোতো থাকতো না। আসলে প্রতিবার সমস্যা থেকে পালানোর সময় সে এটাই ভাবে, কিন্তু দেখে ঘুরে ফিরে সে একই জায়গায় এসে পড়েছে। ছোট বেলায় শোনা রূপকথার গল্পে সেই ভূতের জঙ্গলের মতো জীবনটা। মাইলের পর মাইলের গিয়েও আবার একই জায়গায় এসে উপস্থিত হয় সে। তবে রূপকথার গল্পের শেষে সেই ভূত থেকে মুক্তি ছিল, ছিল জাদু কাঠির ছোঁয়া। সেই রকমই জাদু কাঠির অপেক্ষায় সে বসে আছে। সে জানে এসব কল্পনা করা অবান্তর, তবুও ভাবতে ভালো লাগে।
গরমকাল চারদিক নিস্তব্ধ, দূর থেকে একটা গানের সুর ভেসে আসছে। কি গান সে মনে করতে পারছে না কিন্তু সুরটা বড্ড চেনা লাগছে। গানের সুরটা অমলকিশোর গুনগুন করে যাচ্ছিল মনে মনে। তার মনে পড়ে গেল ছোট বেলার কথা, কত মজাই না হয়েছিল। ব্রতীন, পুস্পেন, সলিল এরা কোথায় আছে এখন। বিদ্যুৎটার সাথে গত বছর পুজোয় দেখা হয়েছিল মহম্মদ আলি পার্কে। কত না দুষ্টুমি করেছে এককালে, পূর্ণেন্দু বাবুর সাইকেলের চাকার হাওয়া খুলে আর সিটে আঠা লাগিয়ে দিয়েছিল পুস্পেন। সলিলের নতুন জামায় কাটাকুটু খেলেছিল ব্রতীন আর অশোক। সে কি হুলুস্থুলু কান্ড, আজকাল অবশ্য এসব মনে পড়লে হাসি পায়। কি পাগলামি না করেছে এককালে, ইচ্ছে করে আবার সেই দিন গুলোতে ফিরে যেতে। কিন্তু হবে কি করে? এতো ওয়ান ওয়ে রাস্তা, অন্তহীনের পথে যাত্রা করেছে, শেষ হয়েছে মৃত্যুতে। নাকি তাতেও শেষ হয় না? এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আরও একটা ঘন্টা কেটে গেল। দুচোখে ঘুম নেই, মাঝে মাঝে মনে হয় ঈশ কেউ যদি ঘুম পাড়াত, পরম ভালবাসায় মায়ের মতো করে। মাঝে মাঝে এই একাকিত্বটা কে বেশ অসহ্য লাগে। মনে করে সে একদিকে আর জগতটা অন্য দিকে। তবুও এতো মানসিক কষ্টের মধ্যে ভেসে আশা গানটা মনটাকে ভরিয়ে দিচ্ছিল, যেমন করে বৈশাখ মাসে বৃষ্টির আগে বিদ্যুৎ ঝলকে উঠে ভরিয়ে দেয় গোটা আকাশটাকে, ঠিক তেমন করে। কিন্তু বৃষ্টি নামতে দিল না সে, তার আগে নিজেকে সংযত করে নিলে। খুব কান্না পেল, মনে হল একছুটে চলে যায়, যে দিকে দু চোখ যায়, কিন্তু ঐ- বিধি বাম। যাক গে এতো সব ভাবতে ভাবতে অমলকিশোর টেবিল থেকে উঠে বিছানায় গেল, লাইট নিভিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করবে বলে। কিন্তু ঘুম এল না, বদলে চোখের কোনায় জল এল। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল, সত্যি তো কর্ম না করে সে ফলের আশা করে কি করে। মাঝে মাঝে মনে হয় তার সে কিসে বিশ্বাস করে- কর্মে না ভাগ্যে ? তবে যাতেই করুক না কেন দুটোর জন্যই টিকে থাকতে হবে। লড়াই তো করতেই হবে।
বাইরে বৃষ্টি নামল হঠাৎ। বৃষ্টির ছাট জানলা দিয়ে আসছিল বটে, কিন্তু অমলকিশোর জানলা বন্ধ করল না। কি রকম একটা উদাস লাগছিল তার। আর কিচ্ছু ভাবতে ভাল লাগছিল না তার। আসলে হঠাৎ হঠাৎ করে এই রকম হয় তার, কোনো ঠিক থাকে না। যখন মন ভারী হয়ে উঠে তখনই এই সব ভাবনা এসে ভীড় করে আরে, আর কান্নারা পাড়ি জমায় তাদের সাথে।
অমলকিশোর কাঁদছে......

অনেকক্ষণ যাওয়ার পর কান্নার স্রোত কিছুটা কমলে, আবার ভাবতে চেষ্টা করলো সে। এখন অনেকটা ভাল লাগছে। তার সাথে বাইরে থেকে জানলা দিয়ে হাওয়াও আসছে, আগের মতো আর গরম লাগছে না। বৃষ্টির তেজটাও কমেছে। অমলকিশোরের মনে হল, ধুর কি হবে ভেবে। যা হবার হবে, খুব বেশি হলে সে কিছু হারাবে, নিঃস্ব হয়ে তো আর যাবে না। আর যদি হয়েও যায়, তখন ওই গরিব মানুষগুলোর মতো হয়ে যাবে, পেটের জ্বালায় তখন তো এই সমস্যা গুলো আর থাকবে না। ধুর ধুর যা হবে হবে।
হঠাৎ মোবাইলটা টং করে বেজে উঠলো। কোনো মেইল এসেছে বা অন্য কোনো নোটীফিকেশন ঢুকলো বোধহয়। খুব একটা ইচ্ছে না থাকেলেও সে সেটা হাতে নিল, অবশ্য অন্য কেউ হলে নিত না। কারণ মোবাইল গুলো একেকটা প্যান্ডোরার বাক্স। খুললেই সমস্যা শুরু। তবুও অমলকান্তি খুলল। কি একটা ফালতু মেইল, ওই you have an offer গোছের। কিন্তু তারপরেরটা ...... মেইলটা দেখে লাফিয়ে ওঠে আর কি সে। আরে এতো সেই 'লেখনী' তে যে কবিতাটা পাঠিয়ে ছিল, সেটা গৃহীত হয়েছে বলে লেখা আছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট খুশি গুলো তার অনেক বড় কিছু সমস্যাকে হার মানায়। এক মুহূর্তে তার মনে হল এ জগতে সেই সবচাইতে খুশি মানুষ এখন। মোবাইলটা পাশে রেখে আনন্দে চোখ বুঝল সে। আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করবে সে, কাল সকালে উঠে নতুন করে শুরু করবে জীবন। জীবন যে রকম সে রকম সে ভাবছে কেন, যে রকম হতে পারে সেটা ভাবা উচিত।
চোখ খুললো আর একবার, ঘুমোবার আগে একবার দেখে নিতে চাইল চারপাশটা। দেখল বৃষ্টি থেমে গেছে। সেই গুমোট ভাবটা আর নেই। আর হ্যাঁ, মেঘ সরে গেছে, আকাশ জুড়ে  তারা ভরে আছে।
                           
ঋণস্বীকার - মাল্যবান , জীবনানন্দ দাশ 

Sunday 20 May 2018

সত্যজিৎ রায়ের মজার ফর্দ

সন্দেশ পত্রিকাতে মাঝে মধ্যে নানা রকম মজার ধাঁধা বের হতো, যার মধ্যে কতকগুলি তৈরী করেছিলেন  সত্যজিৎ রায়। এটি একটি বাজারের ফর্দ। বামদিকে উপকরণ আর ডানদিকে পরিমাণ আছে। দেখুন তো সব কটা পারেন কি না।

ঘুম কেন আসে না আমার ঘরে

বয়সসন্ধিতে অনেকেরই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না, তা এর জন্য বাড়িতে অনেক কথা শুনতো হয়-
" রাত জেগে কি যে করিস, খালি ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ "
"early to bed , early to rise..... ব্লা ব্লা ব্লা "
তা আজ পড়তে পড়তে এর একটা বেশ যুতসই বৈজ্ঞানিক ব্য়াখ্য়া পেলাম। 
আমাদের মস্তিস্কের পিনিয়াল গ্ল্যান্ড মেলাটোনিন হরমোন ক্ষরণ করে, যার ফলে ঘুম পায়। সাধারণত বাচ্চাদের এটা রাতের শুরুর দিকেই ক্ষরণ হয়, আর ঠিক সময় ঘুম পেয়ে যায়। 
কিন্তু টিনএজ এলেই সমস্য়ার শুরু, তখন আর মেলাটোনিন দাদা ঠিক সময়ে আসেন না, আসেন রাত করে ( কি অবাধ্য়ই না হয়েছে মেলাটোনিন )। আর তার ফলেই দেরি করে ঘুম আসে, আর যত সমস্যার শুরু।
অবশ্য বয়স বাড়লে দৈনিক রুটিনের সাথে শরীর adjust হয়ে যায়, তখন no-problem। কিন্তু টিনএজে সমস্য়া হবেই । আর তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতেও দেরি হয়। তাইতো প্রবাদ আছে -
"ভোর ৪টে ওঠা সহজ নয়, কিন্তু ৪টে অবধি জাগা সহজ।"
যাকগে, তা এবার থেকে 
টিনএজার বন্ধুরা ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে কেউ কিছু বললে তাকে এটা শুনিয়ে দিয়ো। 😃😃

ঘুমের দেশ


ঘুমের ঘোরে স্বপ্নদেশে বলবো কথা আজ সারা রাত 

নতুন করে বাঁচতে চেয়ে  মন সাজতে চাইছে নতুন সাজ 
অর্থহীন এই নীরবতা থাক না আরও কিছুক্ষণ 
ভাবতে লাগছে বড্ড ভাল ঢেউ তুলেছে সুর নতুন 
কান্নাভেজা ঝরা পাতা সঙ্গী করে চলতে চাই
হোঁচট খেয়ে বারে বারে রূপকথারা পথ হারায় 
দুর্বোধ্য সব ইশারাতে হচ্ছে কথা অনর্গল 
ঘড়ির কাঁটা থেমে আছে যন্ত্রপাতি সব বিকল 
ঘর ছেড়েছে বাস্তুসাপ পুরানো ঠিকানার সন্ধানে 
ভোরের বেলার ছোট্ট মেয়ে সব অসুখের ওষুধ জানে
জগতবিষ্ণুর পরপারে রণক্লান্ত অবসরে 
থামবে এসে সব গল্প শেষ হবে নতুন করে।।  


জোনাকিরা আলো জ্বালায় কীভাবে ?


রবিবার সন্ধ্যাবেলা, তাতাই তার দাদার সাথে উঠোনে বসে গল্প করছে। গতকাল তাতাই তার মা-বাবা আর দাদার সাথে তাদের দেশের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গ্যালো। কি আর করা যাবে, এখানে তো আর জেনারেটর বা ইনভারটার নেই, অগত্যা অন্ধকারেই বসে থাকতে হলো। তাতে অবশ্য খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিলো না কারণ এখানে উঠোনে বেশ হাওয়া দেয়, ফলে গরম সেরকম লাগছিল না। হঠাৎ কোত্থেকে কতকগুলো জোনাকি উঠোনে চলে এলো। জোনাকি দেখেই তাতাই বলে উঠল – ‘দ্যাখো দাদা কত্ত জোনাকি, আচ্ছা দাদা জোনাকিরা আলো পায় কোথা থেকে ?’ 
দাদা বলল – ‘জোনাকির দেহে
একধরনের রাসায়নিক বস্তু আছে, যার বিক্রিয়ার ফলে আলো বের হয়।’
তাতাই বলল – ‘কি সেই রাসায়নিক বস্তু, আমায় তার গল্প বলো।’
দাদা বলতে আরম্ভ করলো – ‘জোনাকির দেহের শেষ খন্ডকে
ফোটোসাইট নামক একধরনের কোশ থাকে, যার মধ্যে ‘ফায়ারফ্লাই লুসিফেরিন’ নামক এক যৌগ থাকে, যা লুসিফারেজ উৎসেচকের দ্বারা এ.টি.পি. ও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে ডাইঅক্সিটেন গোত্রের এক অস্থায়ী অন্তরবর্তী যৌগ তৈরী করে।’
লুসিফেরিনের সাথে অক্সিজেন ও এ.টি.পি. বিক্রিয়া করে অক্সিলুসিফেরিন তৈরী করে এবং  কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায়

দাদাকে থামিয়ে তাতাই বলে উঠল – ‘
এ.টি.পি. কী ?’
দাদা বলল –
এ.টি.পি. হল সেই যৌগ যা প্রতিটি জীবের দেহে ঘটে চলা প্রত্যেক বিক্রিয়াতে শক্তি যোগায়। এই যে শ্বসনের ফলে গ্লুকোজ ভেঙ্গে শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে , তা এই এ.টি.পি.-র মধ্যে সঞ্চিত থাকে। এবার যখনই শক্তির দরকার হয় তখনই এই এ.টি.পি. ভেঙ্গে প্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহৃত হয় এই যে আমরা হাত পা নাড়াচ্ছি , পেশি সঞ্চালন হচ্ছে, কথা বলছি, তার সমস্ত শক্তি এই এ.টি.পি.-র  থেকেই আসছে। তেমনই জোনাকির আলো জ্বলার শক্তি তাও আসছে এই এ.টি.পি. থেকেই।
তো যা বলছিলাম, লুসিফেরিন থেকে
ডাইঅক্সিটেন গোত্রের যে অস্থায়ী যৌগ তৈরী হয়, সেটি থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায় আর সেটি অক্সিলুসিফেরিন তৈরী করে। এবার এই অক্সিলুসিফেরিন যৌগ উত্তেজিত অবস্থায় আলো বিকিরণ করে। এবার ওই ফোটোসাইট কোশের পিছনে কিছু আয়নার মতো প্রতিফলক কোশ থাকে, যার ফলে বিকিরিত আলো আরও বেশি ‌উজ্জ্বল দেখায়।’
তাতাই বলে উঠল – ‘জোনাকির এই আলো জ্বালিয়ে লাভ কি হয় ?’
দাদা বলল – ‘লাভ তো হয়ই, এই আলোর মাধ্যমে জোনাকিরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রত্যেক প্রজাতির জোনাকির আলোর রঙ বা আলোর জ্বলা-নেভার ছন্দ আলাদা, যা সংকেতের মত কাজ করে। এই আলোক সংকেতের মাধ্যমে অনেক সময় জোনাকিরা শিকারও করে
Photuris verisicolor প্রজাতির জোনাকি শিকার করছে Photinus tanytoxus জোনাকিকে

তাতাই অবাক হয়ে বলল – ‘শিকার করে ? কীভাবে ?’ 
দাদা হেসে বলল – ‘আগেই বলেছি প্রত্যেক প্রজাতির জোনাকির আলোর রঙ বা আলোর জ্বলা-নেভার ছন্দ আলাদা। এবার অনেক সময় এক প্রজাতির শিকারি জোনাকি অন্য প্রজাতির সংকেত নকল করতে পারে, তার মাধ্যমে অন্য প্রজাতির জোনাকিকে কাছে ডেকে নেয়। যাকে কাছে ডাকছে সে বেচারা জানেও না কি বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। এবার ওই জোনাকিটি কাছে আসতেই শিকারি জোনাকিটি হঠাৎ আক্রমণ করে বসে।
তবে শুধু জোনাকিই নয়, টিনোফোরা পর্বের প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এই রকম দেহের থেকে আলো বিকিরণ ঘটে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় এই আলো বিকিরণকে জৈবজ্যোতি বা বায়োলুমিনিসেন্স বলে।’
তাতাই বলল – ‘বাঃ বেশ মজার তো, আচ্ছা দাদা এটা কে আবিষ্কার করেন ?’
দাদা বলল – ‘জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বিজ্ঞানী, জীববিদ্যার উইলিয়াম ম্যাকেলয় আর রসায়নের এমিল হোয়াইট এই জোনাকির বায়োলুমিনিসেন্সের উপর গবেষণা করেন। এমিল হোয়াইট প্রথম লুসিফেরিনের গঠন আবিষ্কার করেন ও কৃত্রিম ভাবে লুসিফেরিন তৈরী করেন। তাদের দুজনকেই এটার আবিষ্কর্তা বলা যায়। তবে এখনও এ নিয়ে গবেষণা থামেনি, এখন চেষ্টা চলছে কীভাবে এই বায়োলুমিনিসেন্সের মাধ্যমে আলো জ্বালানো যায়। এই তো কদিন আগে খবর পেলাম আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির কিছু বিজ্ঞানী এমন গাছ বানিয়েছেন যারা আলো বিকিরণ করে। ভেবে দেখতো, যদি একবার এই গাছ রাস্তার ধারে লাগিয়ে দেয় তাহলে রাত্রি বেলা আর বৈদ্যুতিক আলোর দরকার হবে না, কতও বিদ্যুৎ বেঁচে যাবে। তবে ভাবিস না শুধু বিদেশেই গবেষণা হচ্ছে, আমাদের ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও পিছিয়ে নেই। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ অনুরূপ গোহাইঁ বরুয়া আর তার ছাত্ররা মিলে দেখিয়েছেন জোনাকির মধ্যে সর্বক্ষণ অক্সিজেনের সরবরাহ রাখলে সবসময়ের জন্য আলো জ্বালিয়ে রাখা যায়। এই রকম আলো যদি বড় মাপে বানানো যায় তাহলে তো আরও বিদ্যুৎ বেঁচে যাবে, যেসব মানুষের ঘরে এখনও আলো পৌঁছয়নি তাদের ঘরেও আলো পৌঁছনো যাবে। তবে পুরো বিষয়টাই এখনও গবেষণার পর্যায়ে। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে আমরা এর সুফল পাবো।’

       সবুজপাতা পত্রিকার শীত-বসন্ত সংখ্যা ২০১৮ তে প্রকাশিত

মজার চিঠি

একটা সময় ছিল, যখন বাংলায় শিশুসাহিত্যের বেশ রমরমা ছিল। সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও আরো কত সাহিত্যিক ছিলেন, যাদের হাত দিয়ে বেরিয়েছে অসংখ্য মণিমুক্ত। তখন ছোটোদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকাও ছিল প্রচুর - সন্দেশ, শুকতারা, আনন্দমেলা ও আরও কত কি। সেইসব পত্রিকায় গল্প, ছড়ার পাশাপাশি প্রকাশিত হত মজার কমিকস ও হরেক রকম ধাঁধা। এই রকম কিছু চিঠির ধাঁধা নিয়ে আজকের পোস্ট। প্রথম দুটি প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায়,


আর তৃতীয়টি রইল শুকতারা থেকে
 
দেখি তো বন্ধুরা পারেন কি না। আর বাড়ির ছোটোদেরও করতে দেবেন। 

ভ্রান্ত ধারণার ইতিহাস

এই বছর কার্ল হাইনরিশ মার্ক্সের জন্মের ২০০ বছর পূর্ণ হল। এই বিপুল সময়ে গোটা বিশ্বে অনেক পরিবর্তন এসেছে, সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়েছে, মুক্ত অর্থনীতির জোয়ার লেগেছে সারা বিশ্বে। তবুও মার্ক্সের বক্তব্য গুলির প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। তবে এই সময়ে মার্ক্সের কথার অপব্যাখ্যার সংখ্যাও বেড়েছে। অবশ্য মার্ক্স জীবিত থাকতেই তার কথা গুলির ভুল ব্যাখ্যা শুরু হয়ে গেছিল। আজও বহু লোক মার্ক্সকে ভুল ব্যাখ্যা করেই চলেছেন। তার পাশাপাশি চলে আসছে তার সম্পর্কে কিছু মিথ, বলা ভাল গুজব। তার মধ্যে একটি হল মার্ক্স নাকি বলেছিলেন, তিনি মার্ক্সবাদী নন। অনেকে এই ধারণা বিশ্বাস করেন। যেমন মার্কিন নাট্যকার হাওয়ার্ড জিন তার 'Marx in Soho' নাটকে দেখিয়েছিলেন - মার্ক্স বলছেন, ‘আমি নিজেই কি মার্ক্সবাদী?' তখনও একইরকম বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। 
কিন্তু আসল ঘটনাটা সম্পূর্ণ আলাদা। মার্ক্স-বিশেষজ্ঞ হাল ড্রপার-এর  'Karl Marx and Theory of Revolution' বইয়ে এই ঘটনাটি বিশদভাবে উল্লেখিত আছে। একসময় মার্ক্স তাঁর জামাতা সাংবাদিক পল লাফাৰ্গকে বলেছিলেন, “এই যদি তোমাদের মার্ক্সবাদ হয় তাহলে আমি মার্ক্সবাদী নই।" কারণ লাফাৰ্গ ছিলেন ফরাসী সমাজতন্ত্রী দলের নেতা ও তৎকালীন ফরাসী সমাজতন্ত্রীরা নিজেদেরকে মার্ক্সবাদী বলে আখ্য়া দিত।   কিন্তু তারা যেভাবে মার্ক্সবাদকে ব্যাখ্যা করত তা অপব্যাখ্য়ার সমান। তারা ছিলো সংস্কারবাদী (reformist)। তাই মার্ক্স তাদের প্রতি বিরক্ত ছিলেন এবং সেই বিরক্তি থেকেই ওই বিখ্য়াত উক্তি। পরবর্তীকালে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস বহুবার উক্তিটির কথা উল্লেখ করেছেন মার্ক্সবাদের অপব্যাখ্যা খণ্ডন করার জন্য।
যেমন- 
. ১৮৮১ সালে এডুয়ার্ড বার্নস্তাইনকে একটি চিঠিতে এঙ্গেলস সংস্কারবাদীদের প্রসঙ্গে এইকথা লিখেছিলেন।
২. এরপর ১৮৯০ সালের ৫ আগস্ট কনরাড স্মিডটকে চিঠিতে এঙ্গেলস লিখেছিলেন - And the materialist conception of history also has a lot of friends nowadays to whom it serves as an excuse for not studying history. Just as Marx used to say about the French "Marxists" of the late 'seven ties: "All I know is that I am not a Marxist." ( ইদানিংকালে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার বেশ কিছুসংখ্যক ভয়ঙ্কর বন্ধু দেখা দিয়েছে, যারা এই বস্তুবাদী ধারণাকে ব্যবহার করে ইতিহাসকে না-পড়ার অজুহাত হিসেবে । এই কারণেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে ফরাসী সমাজতন্ত্রীদের সম্পর্কে মার্ক্স মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি যা বুঝতে পারছি তা হল, ‘আমিই তাহলে মার্ক্সবাদী নই’।”) ( সূত্র-  The Correspondence of Marx and Engels, page-415)
৩. ১৮৯০ সালের ২৭ আগস্ট এঙ্গেলস পল লাফাৰ্গকে চিঠি লেখেন। সেইসময়  জার্মান পাটিতে একদল বুদ্ধিজীবী ছিলেন তারা মার্ক্সবাদী বলে দাবী করলেও আসলে ছিলেন সংস্কারবাদী। তাদের সম্পর্কেই বলতে গিয়ে মার্ক্সের মন্তব্যটি স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি লিখেছিলেন -   These gentry all dabble in Marxism, albeit of the kind you were acquainted with in France ten years ago and of which Marx said: 'All I know is that I'm not a Marxist.' ( সূত্র- Marx and Engels Collected Works, Volume 49 : Letters 1890-92, page-22)

এঙ্গলসের এই বক্তব্য থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মার্ক্স কখনই বলেন নি যে, তিনি মার্ক্সবাদী নন। যারা মার্ক্সের বিপ্লবী মতবাদকে সংস্কারবাদে পরিণত করে তাকে মার্ক্সবাদ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাদের প্রসঙ্গেই বিরক্তি সহকারে তিনি ওই উক্তি করেন। 
আসলে মার্ক্সের আসল কথাটি ছিল -  "ce qu'il y a de certain c'est que moi, je ne suis pas Marxiste"।  যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় "what is certain to me is that [, if they are Marxists, then] I am not [a] Marxist". এবার অনেকেই আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে উহ্য় কথাটিকে বাদ দেন। ফলে কথাটির অর্থ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। আর সেই থেকেই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়।