Saturday, 1 May 2021

বঙ্গ-যুদ্ধের দায়

ছোটবেলায় বায়না করে ফুটের দোকান থেকে একখানা ছবিতে মহাভারত কিনেছিলাম। সাধারণত খুবই নিম্নমানের পাতা আর বাঁধাই, ছবিও অপটু হাতে আঁকা। দশ-বিশ টাকায় পাওয়া যেত বলে বাড়ির লোক কিনে দিতে দ্বিধা করেনি। সেই প্রথম মহাভারত পড়া, তার আগে কিছু ছোট ছোট গল্প জানতাম। ছবিগুলো খুব ভাল না হলেও প্রথম পড়া তোহ, তাই মনে দাগ কেটে গেছিল। তাই পরে রাজশেখর বসু বা কালীপ্রসন্নের মহাভারত পড়ার সময়ও কল্পনায় ওই ছবি গুলো ভেসে উঠত। বইটায় স্ত্রী পর্বে একটা ছবি ছিল, অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধের শেষে সমস্ত শব সৎকার করা হচ্ছে, গণচিতার ধোঁয়া আকাশ গ্রাস করেছে।  কেন জানিনা ছবিটা বহুদিন মনে রয়ে গেছিল। তবে সময়ের সময়ের সাথে তা মুছেও যেতে বসেছিল।

কদিন আগে গণচিতা জ্বালানোর ছবি দেখে মহাভারতের সেই ছবির কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ।

কথায় আছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। এক পারিবারিক বিবাদ থেকে আঠারো অক্ষৌহিণী সেনার প্রাণ গেল।

কদিন আগে রাজ্যজুড়ে আঠারো না হোক আট দফায় যুদ্ধ হয়ে গেল, কত রথী মহারথী লড়েলেন, কত বাদবিবাদ, কত হইচই। অনেকের কাছে এ যুদ্ধ ভারত যুদ্ধের মতই গুরুত্বপূর্ণ। যে যার মত করে ভাবছে, সে সঠিক পথে আছে। জয় কার হবে তা সময়ই বলবে। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে সংক্রমণ যে বাড়ল, কত মানুষের জীবন জীবিকা আবার বিপদের সম্মুখীন হল, তার দায় নেবে কে? না কি সবই ওই আনুসাঙ্গিক ক্ষতি, মার্কিনী পরিভাষায় যাকে বলে – collateral damage।


এ যুদ্ধ শেষেও কত গণচিতা উঠবে তার ইয়ত্তা নেই। ভারত যুদ্ধের শেষেও যুদ্ধক্ষেত্র পুরনারীদের হাহাকারে ভরে উঠেছিল – এখনও চারিদিকে হাহাকার উঠছে, অক্সিজেন, বেড, ওষুধের জন্য।

আমি নেহাতই ছাপোষা মানুষ, নির্বাক দর্শক হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। তবে ভারত-যুদ্ধে সব মৃত্যুর দায় নিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি কোন প্রতক্ষ্য হত্যা করেননি কিন্তু তিনিই যুদ্ধের মূল কুশলী ছিলেন, তাই নিজের নৈতিকতার দিক দিয়ে পাপের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেন। পণ্ডিত লোকেরা বলেন এই কারণেই তিনি ভগবান। আবার কেউ কেউ বলেন ভারতভূমি কাউকেই ছাড়ে না, সবাইকে তার পাপের উপলব্ধি করিয়ে দেয়, ভগবান কৃষ্ণ থেকে যুধিষ্ঠির, কেউ ছাড় পাননি। তবে সে তোহ পুরাণের গল্প।

তবে আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এখনকার এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ এত মৃত্যুর দায় কে নেবেন? কে তুলে নেবেন পাপের বোঝা?

ভারতযুদ্ধের মূল কৌশলী সেই দায় নিয়েছিলেন, আজকের দিনে একজন কোন কৌশলী নেই, সব দলেই একাধিক লোক। তবুও সংবাদমাধ্যম কাউকে কাউকে চাণক্য বানিয়ে দেয়। তারাও কি এই বঙ্গ-যুদ্ধের দায় নেবেন?




Thursday, 4 February 2021

অহিংসা

 আজ চৌরিচৌরা ঘটনার শতবর্ষ।

না, এটা সমারোহর সঙ্গে পালন করার মতো কিছু না। এ ছিল কিছু মানুষের নির্মম মৃত্যু, হয়ত তারা অত্যাচারী শাসকের নির্দেশ পালন করছিল। কিন্তু তাই বলে তাদের জ্বলন্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার কোন মানে ছিল না। বড়ই নিন্দনীয় ঘটনা। কিন্তু তাই বলে কি একটি সমগ্র উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তার সামনে বলি দেওয়া যায় ?!



লোকজন গান্ধীজীকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। কিন্তু দেবতারও কি ভুল হয় না? এ কি গুরুপাপে লঘুদণ্ড ছিল না? বারবার এ প্রশ্ন মনে এসেছে, তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ উপলব্ধি করতে পারি।
কেন বারবার গোটা বিশ্বে civil society movement গুলোতে গান্ধীকে এইভাবে স্মরণ করা হয়। কারণ ভদ্রলোক যে রাস্তাটা দেখিয়েছিলেন, তা যেকোন গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলনের সর্বোত্তম পন্থা। যখন গোটা পশ্চিমা বিশ্ব একে অপরকে নির্দয় ভাবে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছিল, ইউরোপে গণতন্ত্র বিপন্ন, ফ্যাসিবাদের উত্থান, তখন সভ্য ভাবে আন্দোলনের এক রাস্তা দেখিয়েছিলেন তিনি।

আমার কাছে গান্ধির প্রথম পরিচয় একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। আর রাজনৈতিক নেতার কর্মপদ্ধতি তাকে সেরা বানিয়ে তোলে, বলে আমার মত। ঠিক যেমন একজন বিজ্ঞানীর শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করি তার কাজের পদ্ধতি দিয়ে। গ্যালিলিও বা নিউটনের থিওরি দিয়ে আজকালকার দিনে বিজ্ঞানের অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু তবুও তাদের কাজের কথা লোকজন স্মরণ করে তাদের কর্মপন্থার জন্য, উদ্ভাবনী ভাবনার জন্য। আর গান্ধীজী রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য যে পন্থা গুলো দেখিয়েছিলেন, তা আজও পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটা অস্ত্র – সে ধর্না হোক কি অনশন কি আইনঅমান্য।

হ্যাঁ, তাঁর আন্দোলনের ইস্যু গুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজনৈতিক ইস্যুর সঙ্গে ধর্মীয় ইস্যুকে (খিলাফত) মিলিয়ে দেওয়া কিংবা শাসকের বিপদের (দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ) সময় আন্দোলন না করা – কিন্তু কর্মপন্থা যে সেরা এ নিয়ে প্রশ্ন নেই। যতক্ষণ একটা আন্দোলন অহিংস থাকে, ততক্ষণ তার প্রতি জনগণের সহানুভুতি থাকে, আর তাতে আন্দোলনকারীদের অংশগ্রহণও বাড়ে। হিংসাত্মক আন্দোলনে সচরাচর যুক্ত হতে সাধারণ মানুষের মনে ভয় করে, কারণ কেই বা চায় বলুন প্রাণ হারাতে।

এই যে যেমন দেখুন, দেশজোড়া কৃষক আন্দোলন। ধরুন আপনি যদি আর্থিক উদারীকরণের পক্ষে হন, আন্দোলনের ইস্যুগুলোকে আপনার গ্রহণযোগ্য নাও মনে হতে পারে, কিন্তু দুমাস ধরে দিল্লির হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় রাস্তায় পড়ে থেকে আন্দোলন দেখে আপনার মনে সহানুভুতি জেগেছিল। তবে যেই ২৬শে জানুয়ারি আন্দোলনে হিংসার ছোঁয়া লাগল সঙ্গে সঙ্গে নানা মহল থেকে তির্যক প্রশ্নবাণ ধাওয়া করলো। অনেক আন্দোলনকারীর উৎসাহেও ভাঁটা পড়েছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল।



এইখানেই বুঝতে পারা যায় গান্ধিজির আন্দোলনের পন্থার গুরুত্ব কতটা। কেন তিনি কয়েকজন পুলিশ কর্মীর মৃত্যুতে গোটা আন্দোলন তুলে নিয়েছিলেন। কেন মার্টিন লুথার কিং থেকে নেলসন ম্যন্ডেলা গান্ধীকে পাথেও বলে মানেন। ভারতে গণতন্ত্র আসার আগেই, এরকম এক অভিনব পথ দেখিয়েছিলেন, তিনি অবশ্যই যুগের থেকে এগিয়ে ছিলেন বলতে হয়। আর তখনই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। আজ যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র আঘাত পাচ্ছে, দিকে দিকে populist নেতাদের প্রভাব বাড়ছে, উগ্র দক্ষিণপন্থার কালো মেঘ উঁকি দিচ্ছে, তখন বোধহয় গান্ধীকে আরও বেশি করে প্রয়োজন।