মনে পড়ে সেই সময়ের কথা, মাধ্যমিকের রেসাল্ট বেরিয়েছে সদ্য। রেসাল্টটা বেশ
ভালই হয়েছিল, অন্তত লোকে তাই বলেছিল। সারাদিন স্তুতি বাক্যশুনে মুখের মধ্যেও একটা হাসি
খেলে গেছিল কোথাও। চেষ্টা করেছিলাম মুখটাকে যথা পূর্বক গম্ভীর রাখতে, কিন্তু পারিনি।
যাক গে স্কুলে গেলাম তারপর আসল রেসাল্টটা আনতে। সেখানে গিয়েই তারপর স্যরেরা অনেকেই
ভাল বলল, আর তারপর যে প্রশ্নটা ছুটে এল সেটা হল, সাইন্স নিচ্ছ তো? এটা একটা ব্যাধি
কি না জানিনা, কিন্তু এ বঙ্গে ছেলে মেয়েরা রেসাল্ট ভাল করলে তাকে সাইন্স নিতেই হয়,
নাহলে মান থাকে না। আমি অবশ্য কোনদিন মানের কথা ভাবিনি। তবুও সাইন্স নিয়েছিলাম। অবশ্য
সাইন্স নেওয়ার প্রস্তুতি মাধ্যমিকের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই নিতে হয়েছিল। মানে সবাই
নেয় আরকি। তবে পরীক্ষার পর এ নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করেছিলাম। কি নেব? কি পড়ব? তা
শেষ পর্যন্ত গড্ডলিকা প্রবাহেই গা ভাসিয়েছিলাম।
এরপর এসে গেছিল সেই ভর্তির দিনটা। নিজের স্কুলেই দ্বিতীয়বার আবার ভর্তি
হলাম। সেদিন খুব মজাও হয়েছিল। কিন্তু ভাবনাটা তখনও যায়নি, ঠিক করলাম তো? পারব তো?
একজনই মাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছিল শুধু, তাও সেটা অনেক পরে অবশ্য, কিন্তু
করেছিল। আমার এক সহপাঠীর ভাই, নাম অভিজ্ঞান। ও আমাদের স্কুলেই পড়ত, আমার থেকে কয়েক
ক্লাস নিচুতে। তো স্কুলেই দেখা হতে ও প্রশ্ন করে, সবুজ দাদা তুমি ইতিহাস নাওনি?
ইতিহাস - আমার প্রিয় সাবজেক্ট কি না জানিনা, কিন্তু বেশ ভালোই লাগত পড়তে।
মাধ্যমিকে ইতিহাসে ৯৫ পেয়েছিলাম, এখনও মনে আছে। এখনকার মত এত এমসিকিউ প্রশ্ন থাকত না
তখন, ফলে নম্বরটা তোলা সহজ ছিল না। বড্ড ভাল লাগত পড়তে। অনেকে ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক
কথা বলে, যে বাজে সাবজেক্ট। কোন লজিক নেই, শুধু সাল তারিখের সালতামামি। কিন্তু আমার
বড় ভাল লাগত, কি সুন্দর গল্পের মত একটা জিনিস। তবে সত্যি কথা বলতে কি, লজিক সব জায়গায়
খোঁজা যেত না, আর খুঁজতামও না। শুধু জীবন আর চারপাশের সাথে মিলিয়ে দেখতাম মিলছে কি
না। মিললে বুঝতাম ইতিহাস ঠিক। না মিললেই প্রশ্ন তুলতাম। আসলে ইতিহাসের গল্প গুলো পড়তে
পড়তে কোথাও একটা হারিয়ে যেতাম, মন যেন টাইম মেশিন হয়ে যেত। মনে হত এই তো আনন্দ, এটাই
জগৎ।
আমার এক মাসতুতো দিদির একটা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ইতিহাস বই ছিল, বইটা নিয়ে
এসছিলাম পড়ব বলে। পড়েও ছিলাম পুরোটা।
আমার ইতিহাস মানে কিন্তু শুধু প্রাচীন কালের রাজারাজড়া নয়, আধুনিক ইতিহাসও
ভাল লাগত। যাতে রোমান্টিসিসম কম, আর ক্রুরতা বেশি। কিন্তু কি জানি, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন
গুলো কি রকম থ্রিলিং লাগত। লোকে আজকাল পলিটিকাল থ্রিলার পড়ে, কিন্তু আমার কাছে ওগুলোই
থ্রিলার ছিল। তবে একটা ব্যাপার, আমি ইতিহাস কে কোন দিন একদিক দিয়ে দেখিনি, মানে ওই
পরীক্ষার আসা প্রশ্নের মতো, যেমন বলা হত আকবর কেন মহান, গুপ্তযুগকে কেন স্বর্ণযুগ বলা
হয়, এই রকম আরকি। আমার কাছে মহানত্বের থেকে বড় ছিল সত্যিটা। মানে যেটা বলা হয় সেটা
সত্যি কি না। এর জন্য অনেক বইও পড়তাম, সব বুঝতাম না অথচ পড়তাম। গল্পের মত পড়তে ভালই
লাগত। আমার কাছে ওগুলো গল্পের বইয়ের মত ছিল। আসলে আমার মনে হয় আমার শুধু একার নয়, ওই
সময় আমাদের স্কুলের দীর্ঘ সময় ধরে পরপর কয়েকটি ব্যাচের কিছু সংখ্যক ছেলেদের মনে ইতিহাস
বাসা বেঁধেছিল। তার একটা কারন ছিল, আমাদের স্কুলের একজন ইতিহাস শিক্ষক, নন্দন কুমার
বসু। তিনি অবশ্য ইতিহাস নিয়ে পড়তে চাননি না কি কোনদিন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তাকে ইতিহাস
নিতে হয়, আর সেই লোকটিই ইতিহাস-প্রীতি ধরিয়েছিলেন বছরের পর বছর হাজার ছাত্রের মনে।
তবে আমার ইতিহাস-প্রেম শুধু ওই কারণেই ধরেছে এটা বললে অত্যুক্তি হবে। আসলে আমার মধ্যে
জানার একটা উদগ্র বাসনা ছিল, মানে আজও আছে। যা কিছু অজানা স-অ-অ-ব জানবো। অনেকটা অভিযাত্রীর
মতো, বইয়ের থেকে তার বাইরের জগতে আকর্ষণ বেশি ছিল, আছে থাকেবে। কোন একটা বিষয় নিয়ে
থেমে থাকতে ভাল লাগে না। কিন্তু সমস্যা হল আমি তো আর অসীমপ্রতিভা ধর নই, তাই সব কিছু
পড়া সম্ভব হল না। একসাথে তাল দিতে পারলাম না। কিন্তু ইচ্ছা, সেটা যাবে কোথায়। মনের
মধ্যে বারবার ধাক্কা দিয়েছে। যতবার ইলেভেন-টুয়েলভে ক্যালকুলাস নিয়ে সমস্যায় পড়েছি,
অঙ্ক কিছুতেই মাথায় ঢোকেনি, বারবার মনে হয়েছে ছুটে যায় ইতিহাসের কাছে। আজকাল তো আর্টসে
নম্বর পাওয়া সোজা হয়ে গেছে, গেলেই ভাল হত। এই মনে হয়েছে বারবার। কিন্তু যেতে গিয়েও
পারিনি। প্রথমত নিয়মের বেড়াজালে, আর তার থেকেও বড় হল জীববিদ্যার মায়া কাটিয়ে যাওয়া।
আসলে ইতিহাসের মতো এও আমার আরেক ভাললাগা। আর একেও লোকে কম দুর্নাম দেয় না। এটাও মুখস্ত
করার বিষয় বলে কি না লোকে তাই। তা লোকের কথায় কান দেই নি, কিন্তু তা বলে ইতিহাসের অমোঘ
আকর্ষণ এড়াতেও পারিনি। তবে এই দ্বন্দের মাঝে একটা কাজ হয়েছে, এর মাধ্যেমে আমি বুঝে
গেছিলাম আমি কি চাই। আসলে আমার স্বপ্নটা একজন পলিম্যাথ হওয়ার। হ্যাঁ, পলিম্যাথ - অনেক
কিছু জানে যে। ভেবে দেখলাম সত্যই তো তাই, বিজ্ঞানের পাশাপাশি পুরাণেও আগ্রহ আমার। সেই
লক্ষেই এগিয়ে যেতে চেষ্টা করি, আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিলাম, যে বিজ্ঞান পড়লে ইতিহাস
নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে চর্চা করাই যায়। কিন্তু উল্টোটা হয় না, কেন জানি না এ এক অদ্ভুত
নিয়ম। দেখবেন অনেক কবি সাহিত্যিক বিজ্ঞানের লোক। কবি নিকোনা পাররা ছিলেন অঙ্কের অধ্যাপক,
আলেকজান্ডার সলঝেনিতসিনও ছিলেন অঙ্কের লোক। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম এটা জেনে। যে
বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ন আহমেদ রসায়ন বিদ্যার লোক ছিলেন। মনে মনে ভাবলাম,
পলিমার নিয়ে পিএইচডি থিসিস লেখার পরও যদি কেউ অমন শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে,
তো সবই সম্ভব। তারপর আস্তে আস্তে যখন আরও জানতে শিখলাম, অনেক লোকের সাথে পরিচয় হল তখন
দেখলাম, যে অনেকেই বিজ্ঞানের লোক, কেউ আইটি ইঞ্জিনিয়ার, কিম্বা কেউ বিজ্ঞানী। তবুও
এরা আপন খেয়ালে নিজের সৃষ্টিতে মগ্ন। আসলে বুঝলাম গোটাটাই এক, সৃষ্টি আর স্রষ্টার লীলা
খেলা মাত্র। আমারা নিজের শুধু দাগিয়ে দিয়েছি, এটা ইতিহাস, এটা বিজ্ঞান, এই বলে। আবার
চাইলাম ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখলাম, দেখলাম সত্যি তো এভাবে কেন দেখি না জীবনটাকে। সবটায়
তো যুক্তিবাদী মনের খেলা, সে ইতিহাস পড়ি আর বিজ্ঞান। যুক্তি দিয়ে বিচার করাটায় আসল।
ঐতিহাসিকরা তো আসলে গোয়েন্দা, সূত্র ধরে ধরে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করে চলেছেন। আর বিজ্ঞানীরা
এটাই করেন, পরীক্ষার ফল দেখে বোঝার চেষ্টা সত্যিটাকে। আসলে তো আমরা সবাই আবিষ্কারক,
খুজে চলেছি অরূপ রতন জীবনের খনি থেকে, যে যার নিজের মতো করে। আস্তে আস্তে নিজেকে জানলাম।
পুরো জানা কখনও যায় না, তাই অনুসন্ধান চলছে। ইতিহাস তো সেটাই যা অতীতচর্চার মাধ্যমে
নিজেকে জানা। নিজের শিকড়কে জানা। তাই বারবার মন চলে যার ইতিহাসের কোলে, মাথা রেখে ঘুমোতে ইচ্ছা করে,
আর মনে হয় আবার সেই টাইম মেশিন চড়ে বেরিয়ে পড়ি মানস ভ্রমণে।
বহুদিন হল ব্যস্ত জীবনের ফাকে আর ইতিহাস পড়া হয় না, সেই যে পাঠ বন্ধ করেছিলাম
আর খোলা হয় নি। খুলব একদিন, খুলতে হবেই, এই আশা নিয়েই থাকি।
একদিন সত্যি ফিরে যাব ইতিহাসের কাছে।
No comments:
Post a Comment