Tuesday 12 June 2018

ভাগাড়ের মাংস ও বাঙালি

কদিন আগে চারিদিকে ভাগাড়ের মাংস নিয়ে হইচই পড়ে গেছিল। তা সেই দেখে একটা পুরাণের একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। একবার দুর্ভিক্ষের সময় বিশ্বামিত্র মুনি খাবার না পেয়ে চন্ডালদের বাসস্থানে ঢুঁ মেরেছেন। কিন্তু সেখানে ঢুকতেই চন্ডালরা তাকে চোর ভেবে ধরে ফেলে, এবার ধরে তো এই মারে তো সেই মারে। এমতাবস্থায় মুনি তো কোনক্রমে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে, অবশেষে তারা মুনির কথা শুনতে রাজি হয়। চন্ডালরা তার কথা শোনার পর তো তাকে পায়ে ধরে বাবা-বাছা বলে ক্ষমা চায়, এই যদি মুনিঋষি কোন শাপ দিয়ে দেন। কিন্তু মুনি শাপ দেবেন কি, তার পেটে তখন ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। উলটে তিনিই চন্ডালদের কাছে খাবার চেয়ে বসেন, একথা শুনে চন্ডাল বলে তারা তো কুকুরের মাংস খায়, এ মাংস কি মুনিবর খাবেন? মুনিবরের তখন যায় যায় অবস্থা। কিছু পেটে পড়লে বাঁচেন। তিনি বললেন - আরে তাই দাও, আমি মন্ত্রবলে কুকুরের মাংস অমৃত করে নেব।
তো তারপর বিশ্বামিত্র সেই কুকুরের মাংস মন্ত্রবলে অমৃততে পরিণত করেন, শুধু তাই নয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন, আর দেবতারা তা গ্রহণও করেন। তারপর সেই প্রসাদ সবাই খায়।
কে জানে আজকালকার রেস্তরার রাঁধুনিগণ হয়ত বিশ্বামিত্রের সেই ফর্মুলা জেনে গেছেন। আর তা দিয়েই কুকুরের মাংসকে অমৃত করে তুলছেন। তবে বাঁচোয়া এই যে আমাদের নেতাগণ এই পৌরাণিক কাহিনি জানেন না, জানলে আর রক্ষে থাকত না। গনেশের মাথার প্লাস্টিক সার্জারির মতো ভাগাড়ের মাংসের এই জাস্টিফিকেশন খুজে বের করতেন।
কিন্তু পুরাকালে না হয়, দুর্ভিক্ষ চলছিল। কিন্তু এখন তো সেরম কিছু ঘটেনি, তবুও আমবাঙালি ঘরের খাবার ছেড়ে দিয়ে ভাগাড়ের মাংসের দিকে চলছিল। কেউ কেউ বলবেন, এসবই পণ্যায়নের যুগের ফল। ওপরের চাকচিক্য দেখে সবাই ছুটছে, ভিতরে কি আছে দেখার দরকার পরে না।
তবে কি শুধুই তাই? তাহলে এরকম ঘটনা অন্য কোথাও ঘটছে না কেন? সরকারি প্রতিনিধিরা বলবেন, হয় হয়। জানতি পারো না। তারা আছেন বলেই এসব না কি ধরে পড়ছে, অন্য কোথাও হলে না কি সেটাই হতো না। কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট নিম্নমানের জিনিস বাঙালি খেয়ে চলছিল, অথচ যতক্ষণ না বাইরে থেকে বলা হল সে খাওয়া থামায়নি। শারীরিক স্বাস্থ্য ব্যাপারটা না হয় ডাক্তারি পরীক্ষায় মাপা যায়, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা মাপবে কে? খাদ্যরুচির মতো অন্যান্য রুচিও কি ডুবে যাচ্ছে। খেয়াল করবেন টিভির সান্ধ্য আড্ডার আসর গুলি। সেখানে একজনের মত অন্য জনের মতকে দাবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, যুক্তির ধার এনারা ধারেন না। যার গলার জোর যত, সেই জেতে। অথচ মানুষ এগুলোই রোজ গিলছে। আর বাংলা সিরিয়ালের কথা না বলাই ভাল। আরও ভাল বোঝা যায় বিভিন্ন ফেসবুকের লেখা থেকে। আজকাল তো সবাই সাহিত্যিক। তো দেখবেন নামী সেলিব্রিটির লেখা ছাড়া যেগুলো বেশি লাইক পায়, শেয়ার হয়, সেগুলো মূলত সস্তা প্রেমের গল্প, না হয় নিম্ন রুচির জোকস ও মিম। এটাই এখন ট্রেন্ড। ইউটিউব ভিডিও বানাতে চান, তো গুচ্ছের গালাগালি দিন আপনি ফেমাস হবেন।
মাঝে মাঝে মনে হয় সীস্যারোর মতো বলে উঠি "ও টেম্পোরা ও মোজ়"। তবে এটাও ঠিক এ জিনিস বাঙালির আজ নয়, চিরকাল হয়েই আসছে বলে বোধ হয়। হুতোম পেঁচার নকশায় দেখবেন, বাঙালির বাবু কালচারের বৃতান্ত। কতটা নিচে নামতে পারে রুচি। মাইকেল মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাই এ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। সপ্তকোটী বাঙালি আর মানুষ হল না বলে দুঃখ করেছেন।
তাই এ দেখেই ভরসা হয়, সব শেষ হয়ে যায়নি, আর যাবেও না। সেইকালে যদি এতকিছুর মধ্যেও ঐরকম সব বিখ্যাত সৃষ্টি হতে পারে, তো আজও হতে পারবে। আর সময়ে দাঁড়িয়ে সময়কে বিচার করা যায় না, আর আমিই বা কে বিচার করার।
তাই তো বলি সমাজ সমাজের মতোই চলবে, কিন্তু তার মধ্যে থেকেই সৃষ্টি হবে ভাল কিছুর, যেমন পাঁকে পদ্ম ফোটে।

এই ভরসা নিয়েই তো বেঁচে থাকা।
চলুক এ জীবন।

1 comment:

  1. আজকের দিনে দাঁড়িয়ে খুব প্রয়োজনীয় এক লেখা। চালিয়ে যাও ভায়া।

    ReplyDelete