Thursday 19 July 2018

পেঁয়াজ কাটলে চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন?

সেদিন ছিল রবিবার, তাতাইদের বাড়ীতে মাংস রান্না হচ্ছে। তাতাইএর ওপর ভার পড়েছিল পেঁয়াজ কাটার। তো পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে তাতাই পুরো নাজেহাল। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে সে কি অবস্থা। হঠাৎ তাতাইএর মাথায় প্রশ্ন এলো আচ্ছা পেঁয়াজ কাটলে চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন। অন্য কোন সবজি বা ফল কাটলে এইরকম হয় না কেন। পেঁয়াজে কি এমন আছে যার ঝাঁজে কান্না পেয়ে যায়। তা দাদাকে প্রশ্ন করতে দাদা বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আজ দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে তোকে পেঁয়াজ কাটলে চোখে জল আসে কেন সেটা বলব।’ 

তো সেই কথা মতো দুপুর বেলা তাতাইকে দাদা পেঁয়াজের কাহিনি বলতে আরম্ভ করল। তবে তার আগে তাতাইকে দাদা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা বলত পেঁয়াজের বিজ্ঞানসম্মত নাম কি?’
তাতাই এটা জানত, সে স্কুলের বইতে পড়েছে, চটপট উত্তর দিল, ‘অলিয়াম সেপা ( Allium cepa )।’
দাদা বলল, ‘তবে শোন, পেঁয়াজের কোশগুলোর মধ্যে অ্যালিনেজ (Allinase) উৎসেচক ও আইসোঅ্যালিন (Isoallin) নামক সালফক্সাইড গোত্রের এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এবার পেঁয়াজ কাটার সময় পেঁয়াজের কোশ গুলোও ছুরির কোপে কেটে যায়, তখন ওই উৎসেচক ও রাসায়নিক পদার্থ বাতাসের সংস্পর্শে বিক্রিয়া করে 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (1-propenyl sulfenic acid) তৈরী করে।
এরপর কোশের মধ্যে থাকা ল্যাক্রিমেটরি ফ্যাক্টর সিন্থেজ (Lachrymatory Factor Synthase) ওই 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড থেকে সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড (syn-propanthial-S-oxaide) তৈরী করে। যার সংকেত C3H6OS
এবার এই  সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড প্রচন্ড উদ্বায়ী, তৈরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসে পরিণত হয়। এবার এই গ্যাস চোখে পৌঁছলে চোখ জ্বালা শুরু করে। সেই জ্বালার ফলে চোখের মধ্যে থাকা স্নায়ু উদ্দীপিত হয় আর মস্তিকে সংবেদনা প্রেরণ করে। তখন মস্তিস্ক সেই জ্বালা কমাতে চোখের মধ্যে থাকা ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিকে জল বের করতে নির্দেশ দেয়। তখনই চোখে জল আসে।’

পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বিক্রিয়া


তাতাই বলল, ‘ আচ্ছা বুঝলাম, তবে রান্না করা পিঁয়াজে এই ঝাঁজ থাকে না কেন।’
দাদা জবাব দিল, ‘রান্না করলে ওই উৎসেচকটি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে আর সাইন-প্রোপানেথিয়াল-এস-অক্সাইড (syn-propanthial-S-oxaide) তৈরী হয় না। ফলে রান্না করলে সেই ঝাঁজ থাকে না। আবার একি ভাবে পেঁয়াজ কুচি কুচি করবার আগে যদি দু টুকরো করে জলে ভিজিয়ে রাখা যায়, তখন ঐ উৎসেচক অনেকটা জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। তখন পেঁয়াজ কোচালে আর ঝাঁজ লাগে না।’
তাতাই বলল, ‘আচ্ছা দাদা তবে রসুনে কান ঝাঁজ হয় না? ওটাও তো অনেকটা পেঁয়াজের মতো।’
দাদা বলল, ‘এটা বেশ ভাল প্রশ্ন করেছিস। আসলে রসুনের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম বিক্রিয়া ঘটে, কিন্তু রসুনে আইসোঅ্যালিনের পরিবর্তে থাকে অ্যালিন (Allin)।  এবার অ্যালিন উৎসেচক অ্যালিনেজের সাথে বিক্রিয়া করে 2-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (2-propenyl sulfenic acid)  তৈরী করে। যেখানে পেঁয়াজে তৈরী হয়েছিল 1-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড (1-propenyl sulfenic acid)। এবার এই 2-প্রোপেনাইল সালফোনিক অ্যাসিড স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিক্রিয়া করে অ্যালিসিন (Allicin) নামক এক থায়সালফোনেট যৌগে রূপান্তরিত হয়। এই অ্যালিসিন কোন জ্বালা সৃষ্টি করে না। তাই রসুন কাটলে কোন ঝাঁজ বের হয় না।’

রসুনের ক্ষেত্রে বিক্রিয়া
  

তাতাই বলল, ‘আচ্ছা আজকাল তো অনেক হাইব্রিড ফল ও সবজি বেরোচ্ছে, তা এমন কোন পেঁয়াজ বানানো সম্ভব নয় যেটায় ঝাঁজ বের হয় না।’
দাদা বলল, ‘ হ্যাঁ, সেরকম কিছু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের একদল বিজ্ঞানী একবার এই রকমই এক হাইব্রিড পেঁয়াজ বানিয়েছিলেন, যা কাটলে চোখে জল পড়ে না। অবশ্য তা বাজারে আসেনি। আসলে গবেষণাগারে অনেক কিছুই তৈরী করা হয়, কিন্তু তার সমস্তই বাণিজ্যিক ভাবে তৈরী করা সম্ভব হয়না। দেখা যায় তাতে যা খরচ পড়বে, তা দিয়ে ব্যাবসা করে লাভ হবে না।
তবে কি জানিস, এই যে চোখের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি, এটা আমাদের চোখকে ভিজিয়ে রাখতে সাহায্য করে। আজকাল স্মার্টফোন আর কম্পিউটারের সামনে অতিরিক্ত চোখ রাখার ফলে অনেকের চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে আর তার ফলে চোখের নানা রকম অসুখ দেখা দিচ্ছে। তাছাড়াও এই ল্যাক্রিমাল গ্রন্থির ক্ষরণের ফলে চোখের মধ্যে পড়া জীবাণু গুলো বিনষ্ট হয় বা ধুয়ে যায়। যা চোখের সংক্রমণ রোধ করে, চোখ ভাল থাকে। তাই বিজ্ঞানীরা বলছে, পেঁয়াজ কাটার ফলে যে চোখ দিয়ে জল ঝরে এটা ভাল। কোন ক্ষতি নেই এতে।’



সবুজপাতা পত্রিকার ১৪২৫ সনের গ্রীষ্ম ও শরৎ যুগ্ম সংখ্যায় প্রকাশিত



2 comments:

  1. এই তথ্য টি খুব গুরুত্বপূর্ণ রোজকার এক বিষয় সম্পর্কিত, অথচ আজকালকার দিনে প্রায় অনেকেই এটা জানে না, এমনকি আমিও জানতাম না।

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete