Tuesday, 3 July 2018

পাঠ পরবর্তী ভাব - তারাভরা আকাশের নীচে - শ্রীজাত



কোন কবি যখন গদ্য লেখেন, তখন তা স্বাদু গদ্য হয়ে ওঠে। আর চার-পাঁচ জন গদ্য লেখকের থেকে ভিন্ন। তেমনই এক উপন্যাস 'তারাভরা আকাশের নীচে'। গল্প শুরু হচ্ছে ১৮৮৮ সালের এক শীতসন্ধে থেকে, যখন আর্লে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের সাথে দেখা করতে আসছেন পল গগ্যাঁ। তিনি যখন কড়া নেড়ে ঢুকে পড়লেন ভিনসেন্টের বাড়িতে, তার পাশাপাশি পাঠকও ঢুকে পড়লেন ভিনসেন্টের আশ্চর্য দুনিয়ায়। যে ভিনসেন্ট চলে এসেছে প্যারিস ছেড়ে, কারণ ঘিঞ্জি প্যারিস তার ভাল লাগছিল না। কোথাও একটা তার মধ্যে নগর সভ্যতা থেকে পালানোর মনোবৃত্তি কাজ করছে।   আর তার সাথে প্রবল এক উন্মাদনা কাজ করছে ভিনসেন্টের মধ্যে। যার জন্য হঠাৎ করে অপমান করে বসেন পল গগ্যাঁকে। সেই উন্মাদনা থেকে কেটে ফেলেন নিজের কান। তারপর সেই রক্ত মাখা কান কাগজে মুড়িয়ে তুলে দেন গণিকার হাতে। এদিকে তাঁর সমস্ত পাগলামি সহ্য করে , তাকে মন প্রাণ দিয়ে সাহায্য করছে তাঁর ভাই থিও ভ্যান গঘ। ভিনসেন্টের জীবনে সে হল পরিবার ও ভিনসেন্টের মাঝে একমাত্র যোগসূত্র।
পাশাপাশি সামন্তরাল ভাবে গল্প এগোতে থাকে ২০১৭ সালে এক বিজ্ঞাপন জগতের কর্মী ঋত্বিকের জীবন ঘিরে। সে আঁকিয়ে হতে চেয়েছিল কিন্তু বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা আর বাড়ির চাপে সে সিধান্ত বদল করে। এছাড়া ঋত্বিক আর তাঁর ভাইয়ের সম্পর্ক ও ভাইয়ের অতীত স্মৃতি এসব তাড়া করে বেরায় তাকে। সব মিলেয়ে মধ্য তিরিশের ঋত্বিক হ্যালুসিনেশনে ভুগতে থেকে। মাঝে মধ্যেই কল্পনার জগতে চলে যায়। তার সব থেকে প্রিয় ছবি 'দ্য স্টারী নাইট'। এসব সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হতে থাকে তাঁর স্ত্রী শর্মিলা। তাকে নিয়ে যায় সাইক্রিয়াটিস্ট রুখসার আহমেদের কাছে। কিন্তু ঋত্বিকের সমস্যা মেটে না।
   

আসলে গল্প বলা এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য নয়। একজন শিল্পীর মধ্যে যে শৈল্পিক উন্মাদনা কাজ করে , যে উন্মাদনা তাঁর কল্পনাকে চাগিয়ে রাখে, সেই উন্মাদনার সাথে বাস্তবটা মেলে না। বা বলা ভাল আর চার-পাঁচ জন যেটাকে বাস্তব বলে দাগিয়ে দিতে চায় সেই বাস্তবের সাথে। যে দ্বন্দে দীর্ণ ভিনসেন্ট ও ঋত্বিক, দুজনেই। আসলে আমরা সাদা চোখে যেটাকে দেখি সেটাকে বাস্তব বলে মেনে নিই। আর যখন অন্য কেউ অন্য কোন ভাবে জগৎকে দেখে সেটাকে আমরা কল্পনা বলে দিই। আসলে বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শুধু আলাদা ভাবে দেখা। কিন্তু জগতের নিয়মে, বলা ভাল গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের নিয়মে যখন সেই আলাদা দেখা তাকে আমরা উন্মাদনা বলে দেগে দিই, তখন সেই ভিন্ন ভাবে ভাবুক মানুষগুলো আমাদের ঠিক করে দেওয়া বাস্তব আর কল্পনার মাঝখানে আটকা পড়ে যায়।
এই মানুষগুলো রাজা সিসিফাসের মতো, যার তেজ সবাই সহ্য করতে না পেরে তাকে সারা জীবন পাথর বইতে দিয়েছিল। যাতে তাঁর তেজ কমে যায়। আমরাও সেরকম এই মানুষগুলোকে শাস্তি দিয়ে ফেলি। আর এরাও তা থেকে পরিত্রাণ পায় না। সিসিফাসের মতো এরাও সারা জীবন এক অস্বস্তির পাথর বয়ে নিয়ে চলে তাঁর গোটা জীবন ধরে। কোন এক সময় সেই ভার অসহ্য হলে এরা থেমে যায়, আর তাতেই এদের মুক্তি। তাতেই এদের প্রকৃত বেঁচে থাকা।
এই উপন্যাসে দুটি মানুষের দুটি সামন্তরাল গল্প যেন বহতা নদীর মতো। তির তির করে বয়ে চলেছে, এক অদ্ভুত সুন্দর ফ্লো আছে এই উপন্যাসে। একদম শেষে গিয়ে দুই নদী সুন্দর ভাবে মিলে যায়। আর  পাঠক, যে কবির হাত ধরে সওয়ার হয়েছিল নদী ভ্রমণের নৌকায়, সেই নৌকা ছেড়ে যাওয়ার পর দুলুনি রয়ে যায় তার মনের শরীরে। সেই দুলুনি নিয়েই শেষ করতে হয় উপন্যাসটি। উপন্যাসের শেষে পাঠক পড়ে থাকেন, এক মোহনায় , যেখানে বাস্তব ও কল্পনার নদী এসে মিলেছে। যেখানে তাদের মধ্যে কোন ভেদ নেই, আছে শুধু মিল। যে গন্তব্যে যেতে চায় ভিনসেন্ট ও ঋত্বিক।


পুনশ্চঃ সম্প্রতি স্বপ্নসন্ধানী তারাভরা আকাশের নীচে উপন্যাস থেকে তারায় তারায় নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে চলেছে। নাটকের নির্দেশনায় কৌশিক সেন। চমকের ব্যাপার ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চরিত্রে অঞ্জন দত্ত। এছাড়া ঋত্বিকের চরিত্রে ঋদ্ধি সেন, শর্মিলার চরিত্রে সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রুখসার আহমেদের চরিত্রে রেশমি সেন। নাটকের আবহ ও সঙ্গীত পরিচালনায় নীল দত্ত। আশা করছি একটি দুর্দান্ত নাটক দেখতে পাওয়া যাবে। সেই আশায় রইল বাংলার নাট্যপ্রেমী মানুষ। 

No comments:

Post a Comment