পল্টুর সন্দেহ
ঢং ঢং ঢং ....
বাড়ির গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটাতে ন’টা বাজল।
ঘড়ির আওয়াজ শুনে পল্টু ওর স্টাডি টেবিল ছেড়ে উঠে
দাড়াল।তারপর একটা লম্বা হাই তুলে দোতলার ঘর থেকে বেরিয়ে নীচের তলার দিকে রওনা হল।
পল্টু ওরফে শ্রীমান প্রতুল মুখার্জী, বালীগঞ্জ গভর্মেন্ট
হাই স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। বন্ধুদের মধ্যে খুবই বিজ্ঞানমনস্ক আর যুক্তিবাদী
বলে পরিচিত। ভূত-ভগবান কিছুতেই তার বিশ্বাস নেই, মায়ের দেওয়া তাগা-তাবিজ কিছুই
রাখেনা। অবশ্য ঘটা করে পৈতেটা নিয়েছিল, সেটা যদিও গিফ্টের লোভে (তবে পল্টু তা
মানতে চায় না)। কিন্তু এর থেকেও মজার ব্যাপার হলো পল্টুর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু অম্বু
ওরফে অম্বরীশ পুরোপুরি উল্টো, ভূতেতো ভয় পায়ই, তার উপর আবার এক শালিখ, এক চোখ দেখা
ইত্যাদি খুতখুতানি লেগেই আছে। এই নিয়ে পল্টু তাকে অনেকবার বুঝিয়েছে, কিন্তু
অম্বরীশের বিশ্বাস যেন চীনের পাঁচিল, শত হূণ আক্রমণেও তা টলবে না। তবে কুসংস্কারের
বাতিকটা বাদ দিলে দুই বন্ধুতে দারুণ মিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে কারেন্ট নুন দিয়ে
কাঁচা কুল খেতে খেতে বাড়ি ফেরা কিংবা গরমকালে লেবুজল দেওয়া বরফ, উফ্ কি আনন্দ যে
লাগে।
সেই অম্বরীশ পল্টুকে ভূততত্ত্ব সম্পর্কে একটা বই পড়তে দিয়েছে, এতক্ষণ সেই বইটাই পড়ছিল সে। দেওয়ার সময় পল্টু অবশ্য বলেছিল – ‘‘দিচ্ছিস দে, কিন্তু এইসব হাবিজাবি বই পড়ে আমি সময় নষ্ট করতে রাজি নই।’’
সেই অম্বরীশ পল্টুকে ভূততত্ত্ব সম্পর্কে একটা বই পড়তে দিয়েছে, এতক্ষণ সেই বইটাই পড়ছিল সে। দেওয়ার সময় পল্টু অবশ্য বলেছিল – ‘‘দিচ্ছিস দে, কিন্তু এইসব হাবিজাবি বই পড়ে আমি সময় নষ্ট করতে রাজি নই।’’
কিন্ত হাজার হোক অম্বু দিয়েছে বলে কথা, তাই সে না
পড়ে থাকতে পারল না।
পল্টু এখন বাড়িতে সম্পূর্ণ একা। ওর মা আর বোন গেছে শ্রীরামপুরে, ওর বড়মাসির মেয়ের বিয়ে।
ওদের কাজের মাসি মানদা মাসিও রান্না-বান্নার কাজ সেরে সাড়ে আটটার মধ্যে চলে গেছে।
বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় এখনো হয়নি। পল্টু ভাবল- ‘‘ যাই এইবেলা চট করে মিলন স্যরের বাড়ি থেকে অঙ্ক খাতাটা নিয়ে আসি।’’ যেমন ভাবা তেমন কাজ।
হঠাৎ, একতলায় নামতে নামতে পল্টু শুনতে পেল নীচ থেকে
একটানা কিরকম একটা
টক টক করে শব্দ হচ্ছে।
‘‘তবে কি ...., ধুর ধুর কি সব ভাবছি
আমি ’’ - নিজেকেই নিজে বকল পল্টু, ‘‘অম্বরীশের
ওই বইটাই যত নষ্টের গোড়া।’’ তবুও মন থেকে সব সন্দেহ দূর না হওয়া পর্যন্ত পল্টু ঠিক ভরসা পাচ্ছে না,
তাই সে পা টিপে টিপে নীচে গেল। গিয়ে বুঝতে পারলো যে আওয়াজটা আসছে রান্নাঘর থেকে।
তারপর সে খুব সাবধানে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল, অতি সন্তর্পণে রান্নাঘরের দরজা
খুলল। এ কি ......
ওহো! মানদা মাসিও না, কাজ করেছে অথচ রান্নাঘরের কলটা
ভালো করে বন্ধ করেনি। আর সেই কারণেই কলের জল তলায় রাখা বাসনের উপর পড়ে ওই রকম
শব্দ হচ্ছিল। “যাক বাবা বাঁচা
গেল!”- অজান্তেই কথাটা পল্টুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
এরপর চটপট তৈরী হয়ে নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে সে সাইকেল
নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় বেরিয়ে দেখলো অন্ধকার, লোডশেডিং হবে হয়তো, বাড়িতে
ইনভার্টার ছিলো বলে বুঝতে পারেনি। যাই হোক, সে চলে গেল মিলন স্যরের বাড়ি, স্যর
বাড়িতেই ছিলেন। পল্টু খাতাটা নিয়ে যখন বেরিয়ে আসছে তখন ওর মনে হলো কিছু যেন তার
পিছনে কে ডাকছে, কিন্তু পিছনে ফিরে তাকাতে কাউকে দেখতে পেল না।
সাইকেলে চড়ে সে যখন যাচ্ছে তখন তার মনে হলো কিছু যেন
তার পিছনে আসছে। কিন্তু থেমে গিয়ে চারদিক চেয়ে দেখল কোত্থাও কিছুই নেই, ফাঁকা
রাস্তা। এবার পল্টু বেশ ঘাবড়ে গেল। তাই সে তাড়াতাড়ি করে সাইকেল চালাতে লাগলো,
কিন্তু অবাক কান্ড, আবার সেই আওয়াজটা, যেন পিছনে কিছু আসছে।
পল্টু এবার সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দিল, কিন্তু আওয়াজটা
কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। প্রাণপণে সে সাইকেল চালাচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি
পৌঁছতো চাইছে।
বাড়ির কাছে পৌঁছে এবার সে আরও অবাক, দেখে বাড়িতে
লাইট জ্বলছে, কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে সে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় লাইট নিভিয়ে
বেরিয়েছিল। এরপর দরজার কাছে গিয়ে দেখে দরজায় তালা নেই। দরজাটা খুলতে গিয়ে দেখে
দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। পল্টুর মাথা এখন ভোঁ ভোঁ করছে, সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে তার।
তাই সাতপাঁচ না ভেবে সে দমাস দমাস করে দরজায় ধাক্কা মারতে লাগলো। হঠাৎ দরজাটা খুলে
গেল।
সোজা তাকিয়ে পল্টু দেখে তার বাবা রাগী রাগী মুখ করে
দাঁড়িয়ে আছেন। এই প্রথম পল্টু বাবার রাগী মুখ দেখেও মনে শান্তি পেল, হাঁফ ছেড়ে
বাঁচল।
কিন্তু বাবা রাগ করবেন কি, পল্টুকে হাঁফাতে দেখে তিনি
নিজেই তাকে ঘরে এনে বসালেন। বাবার থেকেই পল্টু জানতে পারল, যে বাবা আজ তাড়াতাড়ি
অফিস থেকে ফিরেছেন, আর দরজায় তালা দেখে ডুব্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলেছেন। কিন্তু
পল্টু হাঁফাচ্ছে কেন ? তা তিনি জিজ্ঞেস
করায় পল্টু সব কথা খুলে বলে। সমস্ত কিছু শোনার পর তিনি হো হো করে হেসে ওঠেন, আর
পল্টুকে বাইরে এনে দেখান যে তার সাইকেলের পিছন চাকায় একটা শুকনো গাছের ডাল আটকে
আছে। যেটা সাইকেল চালানোর সময় ঘসা খেয়ে আওয়াজ হচ্ছিলো, আর পল্টু ভেবেছে বুঝি তার
পিছনে কিছু আসছে।
এই বলে বাবা হাসতে হাসতে ঘরে চলে যান, কিন্তু পল্টু
দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে পড়ে রাস্তায় যখন সে থেমেছিলো তখন ভালো করে দেখেছিলো,
সাইকেলের পিছনে তো তখন কিছু ছিল না। তবে কি ...............
সবুজপাতা পত্রিকার শারদ সংখ্যা ২০১৭ তে প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment