Sunday, 20 May 2018

জোনাকিরা আলো জ্বালায় কীভাবে ?


রবিবার সন্ধ্যাবেলা, তাতাই তার দাদার সাথে উঠোনে বসে গল্প করছে। গতকাল তাতাই তার মা-বাবা আর দাদার সাথে তাদের দেশের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গ্যালো। কি আর করা যাবে, এখানে তো আর জেনারেটর বা ইনভারটার নেই, অগত্যা অন্ধকারেই বসে থাকতে হলো। তাতে অবশ্য খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিলো না কারণ এখানে উঠোনে বেশ হাওয়া দেয়, ফলে গরম সেরকম লাগছিল না। হঠাৎ কোত্থেকে কতকগুলো জোনাকি উঠোনে চলে এলো। জোনাকি দেখেই তাতাই বলে উঠল – ‘দ্যাখো দাদা কত্ত জোনাকি, আচ্ছা দাদা জোনাকিরা আলো পায় কোথা থেকে ?’ 
দাদা বলল – ‘জোনাকির দেহে
একধরনের রাসায়নিক বস্তু আছে, যার বিক্রিয়ার ফলে আলো বের হয়।’
তাতাই বলল – ‘কি সেই রাসায়নিক বস্তু, আমায় তার গল্প বলো।’
দাদা বলতে আরম্ভ করলো – ‘জোনাকির দেহের শেষ খন্ডকে
ফোটোসাইট নামক একধরনের কোশ থাকে, যার মধ্যে ‘ফায়ারফ্লাই লুসিফেরিন’ নামক এক যৌগ থাকে, যা লুসিফারেজ উৎসেচকের দ্বারা এ.টি.পি. ও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে ডাইঅক্সিটেন গোত্রের এক অস্থায়ী অন্তরবর্তী যৌগ তৈরী করে।’
লুসিফেরিনের সাথে অক্সিজেন ও এ.টি.পি. বিক্রিয়া করে অক্সিলুসিফেরিন তৈরী করে এবং  কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায়

দাদাকে থামিয়ে তাতাই বলে উঠল – ‘
এ.টি.পি. কী ?’
দাদা বলল –
এ.টি.পি. হল সেই যৌগ যা প্রতিটি জীবের দেহে ঘটে চলা প্রত্যেক বিক্রিয়াতে শক্তি যোগায়। এই যে শ্বসনের ফলে গ্লুকোজ ভেঙ্গে শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে , তা এই এ.টি.পি.-র মধ্যে সঞ্চিত থাকে। এবার যখনই শক্তির দরকার হয় তখনই এই এ.টি.পি. ভেঙ্গে প্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহৃত হয় এই যে আমরা হাত পা নাড়াচ্ছি , পেশি সঞ্চালন হচ্ছে, কথা বলছি, তার সমস্ত শক্তি এই এ.টি.পি.-র  থেকেই আসছে। তেমনই জোনাকির আলো জ্বলার শক্তি তাও আসছে এই এ.টি.পি. থেকেই।
তো যা বলছিলাম, লুসিফেরিন থেকে
ডাইঅক্সিটেন গোত্রের যে অস্থায়ী যৌগ তৈরী হয়, সেটি থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায় আর সেটি অক্সিলুসিফেরিন তৈরী করে। এবার এই অক্সিলুসিফেরিন যৌগ উত্তেজিত অবস্থায় আলো বিকিরণ করে। এবার ওই ফোটোসাইট কোশের পিছনে কিছু আয়নার মতো প্রতিফলক কোশ থাকে, যার ফলে বিকিরিত আলো আরও বেশি ‌উজ্জ্বল দেখায়।’
তাতাই বলে উঠল – ‘জোনাকির এই আলো জ্বালিয়ে লাভ কি হয় ?’
দাদা বলল – ‘লাভ তো হয়ই, এই আলোর মাধ্যমে জোনাকিরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রত্যেক প্রজাতির জোনাকির আলোর রঙ বা আলোর জ্বলা-নেভার ছন্দ আলাদা, যা সংকেতের মত কাজ করে। এই আলোক সংকেতের মাধ্যমে অনেক সময় জোনাকিরা শিকারও করে
Photuris verisicolor প্রজাতির জোনাকি শিকার করছে Photinus tanytoxus জোনাকিকে

তাতাই অবাক হয়ে বলল – ‘শিকার করে ? কীভাবে ?’ 
দাদা হেসে বলল – ‘আগেই বলেছি প্রত্যেক প্রজাতির জোনাকির আলোর রঙ বা আলোর জ্বলা-নেভার ছন্দ আলাদা। এবার অনেক সময় এক প্রজাতির শিকারি জোনাকি অন্য প্রজাতির সংকেত নকল করতে পারে, তার মাধ্যমে অন্য প্রজাতির জোনাকিকে কাছে ডেকে নেয়। যাকে কাছে ডাকছে সে বেচারা জানেও না কি বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। এবার ওই জোনাকিটি কাছে আসতেই শিকারি জোনাকিটি হঠাৎ আক্রমণ করে বসে।
তবে শুধু জোনাকিই নয়, টিনোফোরা পর্বের প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এই রকম দেহের থেকে আলো বিকিরণ ঘটে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় এই আলো বিকিরণকে জৈবজ্যোতি বা বায়োলুমিনিসেন্স বলে।’
তাতাই বলল – ‘বাঃ বেশ মজার তো, আচ্ছা দাদা এটা কে আবিষ্কার করেন ?’
দাদা বলল – ‘জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বিজ্ঞানী, জীববিদ্যার উইলিয়াম ম্যাকেলয় আর রসায়নের এমিল হোয়াইট এই জোনাকির বায়োলুমিনিসেন্সের উপর গবেষণা করেন। এমিল হোয়াইট প্রথম লুসিফেরিনের গঠন আবিষ্কার করেন ও কৃত্রিম ভাবে লুসিফেরিন তৈরী করেন। তাদের দুজনকেই এটার আবিষ্কর্তা বলা যায়। তবে এখনও এ নিয়ে গবেষণা থামেনি, এখন চেষ্টা চলছে কীভাবে এই বায়োলুমিনিসেন্সের মাধ্যমে আলো জ্বালানো যায়। এই তো কদিন আগে খবর পেলাম আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির কিছু বিজ্ঞানী এমন গাছ বানিয়েছেন যারা আলো বিকিরণ করে। ভেবে দেখতো, যদি একবার এই গাছ রাস্তার ধারে লাগিয়ে দেয় তাহলে রাত্রি বেলা আর বৈদ্যুতিক আলোর দরকার হবে না, কতও বিদ্যুৎ বেঁচে যাবে। তবে ভাবিস না শুধু বিদেশেই গবেষণা হচ্ছে, আমাদের ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও পিছিয়ে নেই। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ অনুরূপ গোহাইঁ বরুয়া আর তার ছাত্ররা মিলে দেখিয়েছেন জোনাকির মধ্যে সর্বক্ষণ অক্সিজেনের সরবরাহ রাখলে সবসময়ের জন্য আলো জ্বালিয়ে রাখা যায়। এই রকম আলো যদি বড় মাপে বানানো যায় তাহলে তো আরও বিদ্যুৎ বেঁচে যাবে, যেসব মানুষের ঘরে এখনও আলো পৌঁছয়নি তাদের ঘরেও আলো পৌঁছনো যাবে। তবে পুরো বিষয়টাই এখনও গবেষণার পর্যায়ে। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে আমরা এর সুফল পাবো।’

       সবুজপাতা পত্রিকার শীত-বসন্ত সংখ্যা ২০১৮ তে প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment