লোকে বলে অতনুর না কি বেশ ভাল ছেলে, কারুর সাতে পাঁচে থাকে না। কেউ কেউ তো বেশ বুদ্ধিমানও বলে। অতনু এই সব শুনে
মনে মনে খুশি হয়।কিন্তু বাস্তব জীবনে সেসবের কোন প্রতিফলন অতনু দেখতে পায়না।আসলে
অতনুর জীবনে কোনো অ্যাম্বিশান নেই। সে থাকার প্রয়োজন বোধ করেনি। অতনু দেখেছে এই
অ্যাম্বিশান মানে লক্ষ্য ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। এটা থাকে দুইদল লোকের, এক যারা এক্সট্রীম কেরিয়ারিস্ট আর এক যারা একটু শিল্পী মানুষ। নিজেকে এরা একটা
জায়গায় দেখতে চায়, অবশ্য সেই দুইদলের
দেখাটা ভিন্ন, আর অদ্ভুত ব্যাপার
হলো এরা দুইদলই একে অপরের অবস্থানটাকে কটাক্ষ করে। তা এরা তো নিজেদের মতো করে
খুশি। এর বাইরেও একদল থাকে , যাদের সেরম মান বা মানি কোনটাই নেই, আবার কোন স্পেশাল
ট্যালেন্টও নেই। এরা অই গড়পরতা জীবন কাটায়, আর দেশের কিচ্ছু
হচ্ছে না বলে নেতাদের গালাগাল দেয়, কিন্তু আপদে পড়লে
একটা সই এর জন্য কাউন্সিলর বা চেয়ারম্যানের পায়ে গড়িয়ে পড়ে। এদের স্তর ভেদ আছে, যারা একটু বড় তারা একটু বড় মাপের নেতাদের কাছে যায়, কিন্তু
ওই চরিত্র এদের একই। আর এরাই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।
তা অতনু এদের কারুর মধ্যে পড়ে না, অতনুর কোনকিছুতেই সেরম কোন চার নেই। ওই হলেই হোল। বাতিকের মধ্যে একটা স্বভাব
ছিল তা হল বই পড়া। ছিল কারন বলছি স্বভাবটা কদিন হল গেছে। আসলে অনেক বই কেনার
সামর্থ্য অতনুর ছিল না, আর লাইব্রেরীর
অবস্থাও বস্তাপচা, নতুন কোন বই নেই।
আর আসবেই বা কেন, কেউ আর সাধ করে পড়ে না
কি বই। ওই কিছু পয়সা ওলালোকই শখ মেটায়, আর বাকি যাদের শখ
আছে তারা জীবন যুদ্ধে এতটাই ব্যস্ত যে বই পড়ার সময় নেই। অবশ্য অতনুর সময় ছিল। তাই
এক জনের পরামর্শে ইবুক পড়া শুরু করে, প্রথম প্রথম এর ওর
কম্পিউটারে পড়ত। বন্ধুরা ভালবেসে তাকে কিছুক্ষন তাদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে দিতও, কিন্তু কাহাতক আর অন্য বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে বই পড়া যায়। তাই সে পয়সা জমিয়ে একটা
স্মার্টফোন কিনল, ঐ জিএসটি চালু হওয়ার আগে
কোম্পানিগুলো স্টক ক্লিয়ারেন্সের জন্য ভাল সেল দিচ্ছিল সেই সময় সস্তায় পেয়ে যায়।
ওর এক বন্ধুই ওকে বুক করে দিয়েছিল, ও জাস্ট পয়সাটা
দিয়েছিল। প্রথম প্রথম বেশ ভালই চলছিল, কিন্তু সমস্যা শুরু
হল কদিন পর থেকে। ইবুক ছেড়ে ও ইউটিউব ভিডিও আর ফেসবুকে বেশি সময় দিয়ে দিচ্ছিল। ও
বুঝতে পারছিল যে এটা হচ্ছে, কিন্তু বেরতে
পারছিল না। আসলে ও বেরনোর চেষ্টাই করেনি সেভাবে, নাকি করেছিল, কে জানে? ঐ যে বললাম অতনুর চার নেই কোন ব্যাপারে। তো ফেসবুকেই ও কয়েকটা সাহিত্যপ্রেমী
গ্রুপে মেম্বার হয়। সেখানে অনেকেই গল্প লেখে। অতনুও সখ করে কয়েকটা লিখেছিল। কেউ
কেউ প্রথম প্রথম বেশ ভাল বলেছিল, কিন্তু কদিন যেতেই
দেখল ওর গল্প সেরম কেউ নিচ্ছে না। এখানে তিন ধরনের গল্প বা কবিতা চলে, এক সস্তা রুচির প্রেমের কি আবেগের গল্প, দুই ফেসবুক
সেলিব্রিটি নামন এক বিশেষ প্রজাতির গল্প , আর তিন রিয়েল লাইফে
সেলিব্রিটি কিছু পপুলার লেখক লেখিকার গল্প। তাই অতনুর গল্প মার খেল।
আসলে অতনু কিছু বলতে চায় জগতকে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। ওর মনে হয় গল্প লিখি, কিন্তু লিখলে পড়বেটা কে? আর তার থেকেও বড়
কথা লিখতে গেলে একটু কথার মারপ্যাঁচ লাগে। গল্প হয়তো ওর আছে, কিন্তু তার প্রেজেন্টেশন? উপস্থাপনা করবে কি
ভাবে? তাহলে কি ও কবিতা লিখবে? সেখানে তো গল্প উপন্যাসের মতো অত কথা নিয়ে খেলা করতে হয় না। তাও চেষ্টা করেছিল, হয়েওছিল কটা, কিন্তু দশ-বারোটা লেখার পর ও দেখল নতুন কিছু সেরম আসছে না। যেগুলো প্রথমে নতুন
বলে ভ্রম হচ্ছে আসলে সেগুলো পুরানো গুলোই, নতুন রূপে আসছে
শুধু।
এতো গেল লেখার কথা, কিন্তু লিখলে তা দেবে কোথায়? লিটল মাগ্যাজিন
অবধিই তার দৌড়। কিন্তু সেগুল তো বিক্রি হয় আড়াইশ-তিনশ সংখ্যা মতো। বাকি পড়ে থাকে
সম্পাদকের ঘরে গাঁটরি বাঁধা অবস্থায়। তাও সেগুলো পড়ে কজন, আর পড়লেও মনে রাখে আর কে? একটা লেখার আয়ু বড়
জোর তিন মাস, তাও সেটা দুশ লোকের
কাছে মাত্র। কিন্তু অতনুর যে অনেক কথা বলা চাই। বলবে কি ভাবে। তার গলায় সুরও নেই, যে গান গেয়ে বলবে। আর ছবির হাত? থাক সে কথা, স্কুলে বায়লজিতে হৃৎপিণ্ড আঁকায় দশে চারের বেশি পায়নি।
তবে মোবাইলটা হাতে পাওয়ার পর সে ছবি তোলার চেষ্টা
করেছিল কটা। সে যা দেখে তা ক্যামেরা বন্দি করতে চেয়েছিল। কয়েকটা পেরেছিল, কিন্তু অধিকাংশই ব্যর্থ। মনে হচ্ছিল, ইশ যদি একটা
ডিএসএলআর থাকত, তাহলে হয়তো পারত।
কিন্তু সে হওয়ার জো নেই। এইসব দেখে তার মাথায় ফ্লিম বানানোর ভুত চাপে। তা সেটা
বানাতে হলে তো পয়সা চাই, তা দেবে কে? কিন্তু তার চেয়েও দরকার ভাল কিছু সিনেমা দেখা। তাই ঠিক করেছিল দেখবে যখন
সত্যজিৎ রায়কে দিয়েই শুরু করা যাক। তো দেখেছিল অনেক কিছুই, কিন্তু অপুর সংসারটা তার বেশ মনে ধরেছিল, হয়তো কোথাও অপুর
সাথে তার মিল পেয়েছিল। কিন্তু বেশি দূর সে এগতে পারেনি। কারণ অপু তো সে নয়, অপুর কেউ ছিল না। তার বাড়িতে মা বাবা আছে, তাদের কে দেখতে হবে, রোজগার করতে হবে। তাই অপু হয়ে ওঠা তার আর হয়নি। তাই আউট হয়ে যাওয়া ক্রিকেটারের
মতো প্যাভিলয়েনে ফিরে এসেছিল।
তা শেষ পর্যন্ত গল্প লিখবে বলেই মনস্থ করে। তা লিখবে
তো বটে, কিন্তু একটা কথা তার মাথায় এল। সে লিখছে কার জন্য? যদি নিজের জন্য লেখে তাহলে সবাইকে পড়ানোর জন্য এত উৎসাহ কেন? সে ভেবে পেল না কার জন্য লিখছে বা লিখবে। কিন্তু সে লিখবে।
যাই হোক অনেক চেষ্টা চরিত্র করে একখানা গল্প সে দাঁড়
করালো। তবে এবার আর কাউকে পড়ায়নি সে। একেবারে চিঠি করে পাঠিয়ে দিয়েছে 'লেখনী'-র অফিসে। দেখা যাক
বড় পত্রিকায় ছাপে কি না।
তো রবিবার দুপুরে
ফাঁকা সময়ে বসে সে সাতপাঁচ ভাবছিল। হঠাৎ ইচ্ছে হল টস করতে। ভাগ্যের পরীক্ষা হোক, লেখাটা মনোনীত হবে কি হবে না। কয়েনটা ছুড়ল ওপরের দিকে। কয়েনটা ঘুরছে, এই পড়লো বলে।